নারীদের অপূর্ব জাগরণ

ছবি: হাসান রাজা
ছবি: হাসান রাজা

বাংলাদেশের মানুষ আমাকে আজ চেনে মাসিক বেগম পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। ১৯৪৭ সাল থেকে আমি পত্রিকাটি প্রকাশ করে আসছি। তবে এ পর্যন্ত আসার পথটা ততটা মসৃণ ছিল না। ছিল নানা বাধা-বিপত্তি।
বেগম প্রকাশের পেছনে ছোট একটি গল্প আছে। আমার বাবা সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সব সময় ভাবতেন যে মেয়েদের লেখা ও ছবি নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হবে। তিনি প্রতিবছর সওগাত পত্রিকার একটি মহিলা সংখ্যা বের করতেন। তিনি ভাবলেন, বছরে মাত্র একটি মহিলা সংখ্যা বের করে নারীদের এগিয়ে নেওয়া যাবে না। নারীদের জন্য এমন একটি পত্রিকার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি কবি সুফিয়া কামালের কাছে গেলেন। সুফিয়া কামাল আমাদের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমার মায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল। সুফিয়া কামাল বাবার প্রস্তাবে এককথায় রাজি হলেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হলো। আমি হলাম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। সুফিয়া কামাল চার মাস পর ঢাকায় চলে এলেন। এর পর থেকে আমি পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখনো বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। তবে আর্থিক কারণে মাঝেমধ্যে পত্রিকার প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে পড়ছে।
আমার শৈশবকালে গ্রামবাংলার সমাজ ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ইংরেজি বা বাংলার কোনো চর্চা ছিল না। আমার বাবা কলকাতা থেকে সওগাত বের করতে শুরু করেন আমার জন্মের আগেই, ১৯১৮ সাল থেকে। সম্ভবত সেটিই বাঙালি মুসলমানদের ছবিসহ প্রকাশিত প্রথম মাসিক পত্রিকা। তিনি সে যুগের অবরোধ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন। আমাকে ও আমার মাকে তিনি গ্রাম থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। আমার বয়স তখন তিন কি সাড়ে তিন বছর। শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রার পার্থক্য কেমন ছিল, সে বয়সে আমি তা বুঝে উঠতে পারিনি।
আমার বাবা আমাকে আলোর পথ দেখান। বাবা বাড়িতে শিক্ষিকা রেখে মা ফাতেমা খাতুনকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কলকাতায় আসার পর বাড়িতেই আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। চার বছর বয়সে ভর্তি হই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে। বাবার সঙ্গে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার আগে থেকেই জানাশোনা ছিল। টেলিফোনে তাঁদের কথাবার্তা হতো। তাঁর অনুরোধে বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এভাবে আমার পড়ালেখা চলতে থাকে। সে সময় একটি বিষয়ে আমার খুব আগ্রহ ছিল। তা হলো বিভিন্ন বই বা পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখা। বাবা আমার এই আগ্রহের কথা জানতে পেরে ফুল, ফল, পাখির ছবি ছাপানো বই আমার জন্য সংগ্রহ করে আনতেন। আমি রাতের বেলা পাতা উল্টে উল্টে সেসব ছবি দেখতাম। খুব আনন্দ পেতাম। সম্ভবত সেই বয়স থেকেই প্রতিদিন পত্রিকা দেখা আমার নেশা হয়ে যায়।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর দেখলাম, বাবা মেয়েদের ছবি ও লেখা নিয়ে সওগাত-এর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। সে যুগে মেয়েদের কোনো লেখা বা ছবি পত্রিকায় ছাপা হবে, তা কেউ ভাবতে পারত না। সওগাত-এর সদস্যরা ঠিক করলেন, মেয়েদের ছবি বা লেখা ছাপানোর সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েছে, তখন তাঁরা এগিয়ে যাবেন। তাঁরা তাঁদের স্ত্রী ও বোনদের লেখা ও ছবি পত্রিকায় ছাপানোর জন্য দিলেন। ১৯২৯ সালে সওগাত-এর প্রথম মহিলা সংখ্যা প্রকাশিত হলো। এ সময় আমাকে বাবা শিখিয়েছিলেন কোন ফাইলে কার লেখা আছে, কোন ফাইলে মহিলাদের ছবি আছে। এসব গুছিয়ে রাখা আমার কাজ ছিল।
১৯২৬ সাল থেকে সুফিয়া কামাল নিয়মিত সওগাত-এ লিখতেন। তবে সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের কারণে সওগাত-এর প্রথম মহিলা সংখ্যায় তিনি কোনো ছবি দিতে পারেননি। পরের বছর ১৯৩০ সালে সওগাত-এ তাঁর প্রথম ছবি প্রকাশিত হয়। বাবা নিজে তাঁকে ছবি তোলার জন্য স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সওগাত-এর প্রথম মহিলা সংখ্যা বের হওয়ার পর বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত সমাজে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকেই বাবাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন। বাবা একটি গোঁড়ামি ভাঙলেন। নারী জাগরণের যে বীজ তিনি বপন করলেন, সেটাই আমি এখনো লালন করে যাচ্ছি। বাবার সঙ্গে থেকে থেকে আমি শিখেছি, মেয়েদের তিনি কোন দিকে নিয়ে যেতে চান।
আমার প্রথম লেখা ছাপা হয় সওগাত-এর ঈদসংখ্যায়। আমার বয়স তখন ১৫ বছর। সেটি ছিল একটি প্রবন্ধ। লেখার বিষয়বস্তু এখন আর মনে নেই। এর পর থেকে সওগাত-এর প্রতিটি ঈদসংখ্যায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য বাবা আমাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। সেসব প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীরা আমাকে আশীর্বাদ করতেন। তাঁরা বলতেন, মা, বাবার কাজটাকে এগিয়ে নিয়ো। তুমি নিশ্চয়ই পারবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরাও সওগাতকে নিরপেক্ষ পত্রিকা বিবেচনা করতেন। তাঁরা যেমন এতে বিজ্ঞাপন দিতেন, ইংরেজ প্রতিষ্ঠানগুলোও দিত।
বেগম প্রকাশিত হওয়ার পরের মাসেই দেশ ভাগ হয়ে যায়। পরিস্থিতি তখন এতটাই অস্থিতিশীল ছিল যে মেয়েদের লেখা পাওয়ার উপায় ছিল না। বাবাকে তখন সওগাত পত্রিকায় আগে প্রকাশিত মেয়েদের বিভিন্ন লেখা বেগম-এ দিতে হতো। ১৯৪৮ সালে বেগম-এর প্রথম ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয়। তখন পর্যন্ত অন্য কোনো পত্রিকা এ ধরনের কোনো সংখ্যা বের করেনি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে আমাদের ঢাকায় চলে আসতে হয়। একটি হিন্দু পরিবারের সঙ্গে আমরা আমাদের বাড়ি ও প্রেসটি বিনিময় করি। এখানে এসে উঠি ৬৬ পাটুয়াটুলীতে। এখনো সেই প্রেস থেকে বেগম-এর প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।
বেগম-এর মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে আমরা বেগম ক্লাব গঠন করি। সে ছিল এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমাদের অবস্থা তখন খুব একটা ভালো নয়। নারী লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সে সময় খুব কঠিন ছিল। সহজে কোনো লেখা পেতাম না। এখন ইন্টারনেটের সহজ যোগাযোগব্যবস্থার যুগে সে কষ্টের কথা বলে বোঝানো যাবে না। এ সময় একজন মার্কিন নারী সাংবাদিক এলেন বেগম-এর অফিস দেখতে। তিনি আমাদের এ অসুবিধা শুনে একটা মহিলা ক্লাব গঠন করার পরামর্শ দিলেন। সেখানে মেয়েরা আসবেন, কথা বলবেন, তাঁরাই বেগম পত্রিকার জন্য লিখবেন। সেই থেকে বেগম ক্লাবের সৃষ্টি।
সেটিই ছিল বাংলাদেশে নারী লেখকদের প্রথম কোনো ক্লাব। শামসুন্নাহার মাহমুদকে প্রেসিডেন্ট করে ক্লাবটি গঠন করা হলো। উপদেষ্টা ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, ফাতেমা সাদিক ও নীলিমা ইব্রাহিম। এই ক্লাব আমাদের পত্রিকা প্রকাশের কাজটি অনেক সহজ করে দিল। ক্লাবটির কল্যাণে আমরা বহু নতুন নারী লেখকের সন্ধান পেয়েছি। নানা অসুবিধার কারণে ১৯৭০ সালে ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সঙ্গে ১৯৫২ সালে আমার বিয়ে হয়। বেগম পত্রিকার প্রকাশে তিনি আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন। এখন সহযোগিতা করছে আমার দুই মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খান ও রিনা ইয়াসমিন আহমদ। আমি আমার বাবার ইচ্ছা পূরণ করেছি। আশা করছি, আমি যখন থাকব না, আমার দুই মেয়ে তখন আমার ইচ্ছা পূরণ করবে। বেগম পত্রিকার প্রকাশ তারা অব্যাহত রাখবে।