রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় কল শুনে দরজা খুলে দিলেন আজিম উদ্ দৌলা নিজেই। হাতে টিভি রিমোট। বিশাল পর্দায় চলছে রান্নাবান্না। সেদিকে তাকিয়েই বললেন, ‘আমি যতক্ষণ বাড়িতে থাকি, এসব খাওয়াদাওয়ার চ্যানেল চলতে থাকে।’ খাবার টেবিলে ওই এলাকার জনপ্রিয় ‘বোবার বিরিয়ানি’ সাজিয়ে রেখেছেন এই মডেল। খাওয়াদাওয়া শেষে নিজ হাতে বানিয়ে আনলেন চা। চায়ের চুমুকে শুরু হলো সদ্য প্যারিস থেকে ফেরা আজিমের সঙ্গে কথোপকথন।
প্রশ্ন :
প্যারিস ফ্যাশন উইকে অংশ নেওয়ার চমৎকার বিষয় কোনটি ছিল?
মূল্যায়ন (অ্যাপ্রিসিয়েশন)। ওরা কাজটাকে এত ভক্তি করে। যে যেই কাজটা করে, সে সেটা তত ভালোবেসে, গুরুত্ব দিয়ে করে সেখানে সমাদর পাওয়া আমাকে উজ্জীবিত করেছে।
প্রশ্ন :
কী নিয়ে এলেন প্যারিস থেকে?
খুবই ব্যস্ত ছিলাম। শো শেষে আরও কিছু শুট করেছি, মিটিং করেছি। আালাদা করে কেনাকাটা করার সময় পাইনি। কিছু স্যুভেনির, সুগন্ধি, চকলেট, আর দারুণ সব স্মৃতি নিয়ে ফিরেছি।
প্রশ্ন :
কেমন সেসব স্মৃতি?
ওখানকার অনুভূতি অন্য রকম, সব শহর থেকে আলাদা। বিশ্ব শিল্প আর সংস্কৃতিতে ফ্রান্সের অবদান অনন্য। ওখানকার পথেঘাটে, এখানে–সেখানে সেই আমেজ মেলে। বেশ কিছু চিত্রকর্মের প্রদর্শনী দেখেছি। এগুলোর সঙ্গে বিশ্বের অন্য কোনো প্রদর্শনীর তুলনা হয় না। আর খাবার...এ নিয়ে যত যা কিছুই বলি না কোনো, কম হবে।
প্রশ্ন :
বাহ্! আচ্ছা, আপনি কেন মডেল হলেন?
আমার জন্ম, বড় হওয়া বাগেরহাটে। এইচএসচি পরীক্ষার পর আমরা ঢাকায় চলে আসি। ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। কলেজে বন্ধুরা এমনিতেই আমাকে দেখিয়ে বলত, ‘ও জানি কোথায় লুকায়া জিম করে।’ স্কুল–কলেজে থাকতে খেলাধুলা করতাম। সারা দিন ক্রিকেট খেলতাম। ফিটনেস ছিল। কিন্তু জিম করতাম না।
সেই সময় আমার যে বন্ধুরা ছিল, তাদের একজন আফজাল মডেলিং করত। ও প্রথম বর্ষেই পড়াশোনার জন্য লন্ডন চলে যায়। আমার লুক, হাইট এইগুলো দেখে আমার অন্য বন্ধুরা একটু খোঁচা দিয়েই বলত, ‘ও যদি মডেলিং করে, তুই কেন করবি না।’
তো ওই বন্ধু লন্ডনে যাওয়ার আগে আমি আর সে মিলে একটা ফটোশুট করেছিলাম। আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। আমার বন্ধু সোহেল আর ফয়সালের অনুপ্রেরণায় আমি সেই ছবি ‘আইস টুডে’ আর ‘ক্যানভাস’ ম্যাগাজিনে দিই। দিয়ে ভুলেও যাই। বছরখানেক পর দুটো জায়গা থেকেই ডাক আসে। ফটোশুট হয়। ‘আইস টুডে’র সেই ছবি দেখে একস্ট্যাসি থেকে আমাকে ডাকল। ডেনিমের একটা প্রচারণার জন্য। আর ওটা মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। এরপর একস্ট্যাসির স্বত্বাধিকারী, ওই শুটের আলোকচিত্রী, মেকআপ আর্টিস্ট, স্টাইলিস্ট, সিনিয়র মডেল সবাই আমাকে পছন্দ করল। আমি ফ্যাশন হাউস ক্যাটস আইয়ের কাজ পেলাম। ব্র্যান্ড মডেল হিসেবে দুই বছরের চুক্তি হয় তাদের সঙ্গে। এরপর বাংলালিংকের একটা টিভি বিজ্ঞাপন করি। ঢাকা ফ্যাশন উইকে অংশ নিই। বাটেক্সপোর ফ্যাশন শোতে অংশ নিই। প্রচুর কাজ পাই। বিবি রাসেলের সঙ্গে কাজ করি। বিবি রাসেল আমাকে ভারতের একটা মডেলিং এজেন্সির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই এজেন্সি থেকেই দীপিকা পাড়ুকোন, ডিনো মারিও, জন আব্রাহামদের শুরু হয়েছিল। আমি এখানে কিছু কাজ করি।
প্রশ্ন :
তারপর?
অনেকে আমাকে বলেছিল মুম্বাইয়ে ক্যারিয়ার গড়তে। কিন্তু আমার মনে হলো, ওখানে তো আমাদের দেশের অনেকেই যায়। আবার লুকটা অনেকটা একই রকম। আমি দেখলাম, মডেলিংয়ে কোন শহর বিশ্বের সেরা। ইন্টারনেটে সার্চ করে পেলাম ইতালির মিলান শহরের নাম। মিলানের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তাঁর নাম ফ্রান্সিস। তিনি মিলান ফ্যাশন উইকের অন্যতম আয়োজক। আমাকে যেতে বললেন, তবে এ–ও বললেন যে সবকিছুই অনিশ্চিত।
আমি মিলান গিয়ে শুনলাম, ফ্রান্সিস তাঁর ব্যবসা গুটিয়ে সাংহাই (চীন) চলে গেছেন। ফলে তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। আমি ওখানে কয়েকটা এজেন্সিতে যাই। তারা আমাকে খুবই পছন্দ করল। কিন্তু আমার ইতালিতে কাজ করার জন্য অনুমোদনপত্র (ওয়ার্ক পারমিট) ছিল না। আমি আর কাজ করতে পারিনি। সেখান থেকে লন্ডন যাই। তারপর ঘুরেটুরে কিছু শুট করে দেশে চলে আসি।
প্রশ্ন :
প্রায় এক যুগ আপনি কাজ করছেন দেশের মডেলিং শিল্পে। এখান থেকে আপনার সবচেয়ে বড় পাওয়া কী?
আমি বিশ্বের যেখানেই গেছি, কাজ করে তাদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায়, ওরা আমাকে এক রকমের ‘দেবতাজ্ঞান’ করে। আমি প্রথম দিন যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, এখনো আমার তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। একটি ব্র্যান্ড একজন মডেলকে নিয়ে খুব বেশি সময় কাজ করে না। নতুন মুখ আনে। আমি কাজ না করলেও সবার সঙ্গে পরিবারের মতোই একটা ভালো সম্পর্ক আছে।
প্রশ্ন :
মডেলিং নিয়ে একটা ভুল ধারণা বলেন।
মানুষ ভাবে যে মডেল হতে গেলে ম্যানিকুইন হতে হয়। একদমই নয়!
প্রশ্ন :
এ জেড (আজিম উদ দৌলার ফ্যাশন ব্র্যান্ড) কেন আনলেন বাজারে?
অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম। তারপর ২০১৯ সালের ঈদুল আজহায় শুরু করলাম। মডেল হিসেবে আমি সব ডিজাইনার, ফ্যাশন হাউসের স্বত্বাধিকারীদের সঙ্গে কাজ করেছি। মনে হলো, যা আছে, এর বাইরে যদি কিছু আনা যায়, অন্য রকম কিছু, যেটা একটা ভালো সংযোজন হতে পারে। জুরহেমের চেয়ারম্যান সাদাত চৌধুরী সেই সময় আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আমার শোরুমে ১০ জন আছে। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ করাই। এথনিক ওয়্যারের জন্য আলাদা সংগ্রহ আছে আমার। চামড়া নিয়ে আমি অনেক আগে থেকেই কাজ করি। চামড়াজাত পণ্য তৈরির নিজের একটা জায়গা আছে হাজারীবাগে। ভালোই চলছে। আমার স্বপ্ন হলো, এ জেডকে বিশ্বের বড় বড় শহরে নিয়ে যাওয়া।
প্রশ্ন :
এত দীর্ঘ সময় সফল মডেল হিসেবে ক্রিজে থেকে কীভাবে ছক্কা পিটিয়ে চলেছেন?
আমি যখন শুরু করি, তখন কোনো ব্র্যান্ড একজন মডেলকে এক দিনের জন্য নিলে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা দিত। তাতেই মডেলরা খুশি থাকত। আমাকে যখন দেশের একটা বড় ব্র্যান্ড ২০০৯ সালে ডাকল, আমি তখন এক দিনের জন্য চেয়েছিলাম আশি হাজার টাকা। ওরা শুনে আর কোনো কথাই বলেনি। আমি কাজটা পাইনি। তারপরই আমি দিনপ্রতি এক লাখ টাকা হিসেবে কাজ করেছি। আমার মনে হয়েছে, আমাকে নিতে হলে এ রকমই পে করতে হবে। যে ব্র্যান্ড আমাকে ‘এফোর্ট’ করার সামর্থ্য রাখে, আমি সেটার কাজ করব।
তখন আমি সবে এসেছি বাগেরহাট থেকে। নতুন নতুন। তবু আমি কখনো খোঁজখবর না নিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলিনি। আমি নিজের ও ব্র্যান্ডের মানের সঙ্গে কখনো আপস করিনি। আমাকে ৫০ জন ডাকলে ব্যাটে–বলে একটা মিলত। আমি সেই একটা কাজই করেছি। শুরুতে যারা ডাকত, তারা তো আশাই করেত না যে একজন মডেল এমন প্রশ্ন করবে। আমি সব জেনেশুনে বুঝে তারপর না বা হ্যাঁ করতাম। কম টাকায় বা বিনা মূল্যে কাজ করে কিন্তু আপনি এই শিল্পের উপকার করলেন না, ক্ষতি করলেন। এখন যে বাংলাদেশে মডেলদের পারিশ্রমিকের একটা কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে, আমার মনে হয়, আমার সেখানে অবদান আছে।
প্রশ্ন :
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের মডেলিং জগতের মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
এখন আমাদের মডেলিং এজেন্সি দরকার। যেমন পোশাকের বিভিন্ন ব্র্যান্ড আছে, সবার মান এক রকম নয়। একটা শার্টের দাম ২০ হাজার টাকা হতে পারে, আবার ২০ টাকাও হতে পারে। এজেন্সিও সে রকম হবে। তাতে মডেলদের পথচলা অনেক সহজ হয়ে যায়। গ্রুপিং, নানা রাজনীতি, নানা দৌড়ঝাঁপের পর ফলাফল শূন্য—এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। তাই দেশের মডেলিং খাতের পরবর্তী পদক্ষেপ হওয়া উচিত এজেন্সি। আমাদের তো এজেন্সির সংস্কৃতি নেই। এখানে বাইরের কোনো বড় এজেন্সির ফ্র্যাঞ্চাইজি আনা যেতে পারে। একটা গাইডলাইন পেলে ওই ছক মাথায় রেখে পরে আমরা নিজেরা হয়তো সব করতে পারব। ছকটা বুঝে নেওয়ার জন্য।
প্রশ্ন :
আপনি মডেলিং করতে চাইলে পরিবার কীভাবে নিল বিষয়টা?
আমার প্রথম শুটই ছিল একস্ট্যাসির সঙ্গে। ডেনিমের ছোট টপ পরা, স্টাইলিশ মডার্ন পোশাক। যে ক্যাটালগটা বের হলো, আমি সবার আগে মাকেই দেখিয়েছি। আমার বোন, ভাগনে–ভাগনিদের দেখিয়েছি। সবাই দেখে মহাখুশি। একজন রাজনীতিবিদের কাজ রাজনীতি করা, শিক্ষকের কাজ পড়ানো, দারোয়ানের কাজ পাহারা দেওয়া, আমার কাজ মডেলিং করা। এইটা কোনোটা থেকে বড়ও না, ছোটও না। আমার কেবল না, কারও নিজের পেশা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন :
আপনার পেশাগত যাত্রায় প্রথম আলোর ভূমিকা কেমন ছিল?
এটা আপনি বাদে অন্য কেউ জিজ্ঞেস করলেও আমি একই উত্তর দিতাম। আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রথম আলো আমার পাশে ছিল। আমরা যাঁরা মডেলিং করি, আমাদের একটা নিশ, পশ ইন্ডাস্ট্রির মানুষ চেনে। কিন্তু প্রথম আলোর মাধ্যমে, বিশেষ করে নকশার মাধ্যমে আমি গণমানুষের কাছে পরিচিত মুখ হতে পেরেছি।