নিজের লেন্সে ফারা

গায়ের রঙের জন্য একসময় নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন ফারহানা ফারা। আর এখন গায়ের রংটাকেই মনে করেন তাঁর স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম স্মারক। ফারহানা ফারা একজন ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী। জনপ্রিয়তা পেয়েছে তাঁর পোর্টেবল স্টুডিও। ফারার পালাবদলের গল্প শুনুন এখানে

ফারহানা ফারা
ছবি: লেখক

বিয়ে করে সংসারী হওয়ার সব প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু জন্মসূত্রে পাওয়া গায়ের রংটা তাঁর বউ হওয়ার স্বপ্নটাকে চুরমার করে দিল। বিয়ের ঠিক আট মাস পূর্ণ হতেই হাতে এসে পৌঁছাল নীলচে রঙের তালাকনামা। আবার মা-বাবার কাছে ফিরে গেলেন ফারহানা ফারা। পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় শুরু হলো নতুন জীবনের জন্য সংগ্রাম। আবার পড়াশোনায় মন দিলেন ফারা। নিজের সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ করে কাঁদতে কাঁদতেই ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন পুরো পরিবার একসঙ্গে কেঁদেছিল। তবে সেটা ছিল আনন্দের কান্না। কারণ, ওই একটা বছরের মধ্যে এত চড়াই-উতরাই পেরিয়েও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ফারা।

এরপর শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। যে যুদ্ধের নাম চাকরি খোঁজা। বলেন, ‘যখন যা পেতাম, তা-ই করতাম। কারণ, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইতাম। ওই সময় বন্ধুরা অনেক সহযোগিতা করেছে। চট্টগ্রামে ২০১০ সালে অটবিতে প্রথম চাকরি শুরু করি। তখন প্রতিদিন চোখে কাজল দিয়ে যেতাম। আমি চাইতাম না সহকর্মীরা আমার কান্নায় ফুলে যাওয়া চোখ দেখুক। মজার ছলেই কেউ কেউ জিজ্ঞেস করত, আপা, মাসে কত কেজি কাজল লাগে আপনার। চট্টগ্রাম শহরটা ছোট, প্রতিদিনের যাওয়া-আসায় হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত সাবেক স্বামী বা তাঁর পরিবারের কারও সঙ্গে। নিজেকে এই চাপ থেকে মুক্ত করতে ২০১৩ সালে আবার ঢাকায় ফিরে আসি। যোগ দিই নতুন কর্মস্থলে। একটু বিরতি নিয়ে ভর্তি হই মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এমবিএ)।’

ডিপ্লোমা কোর্সে নিজেকেই বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন ফারা
ছবি: ফারার সৌজন্যে

ফুল-পাখি দিয়ে শুরু

বড় ভাইয়ের পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা দিয়েই প্রথম ছবি তোলা শুরু। ফুল, পাখির ছবি তুলে আনন্দ পেতেন ফারা। তবে অফিসের বারান্দার কাচে সহকর্মীর প্রতিফলনের ছবি দিয়েই তাঁর প্রথম দৃক প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া। সেটাই ফারার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, বাড়িয়ে দেয় আত্মবিশ্বাস।

ফটোগ্রাফিকে ভালো করে জানার আগ্রহ থেকেই ২০১৫ সালে ভর্তি হন ফটোগ্রাফি স্কুল ‘কাউন্টার ফটো’তে। পাশাপাশি চলতে থাকে চাকরি আর এমবিএ। অ্যাডভান্স কোর্স শেষ করে সে বছরই কাউন্টার ফটো থেকে ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য পান ফুল স্কলারশিপ। সেই শুরু! চাকরি আর এমবিএ ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে শুরু হয় ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা।

নিজের জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতাগুলোকে ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললেন ফারা
ছবি: ফারার সৌজন্যে

ডিপ্লোমা কোর্সের ফাইনাল প্রজেক্টে নিজেকেই বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন ফারা। ‘আনরেভেলিং দ্য পাজল ইনসাইড’ নামের প্রকল্পে নিজের জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতাগুলোকে ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললেন। ছবি তোলার এই প্রক্রিয়া তাঁর জীবনে থেরাপির মতো কাজ করেছিল। অনেক বছর ধরে জমে থাকা মানসিক বাধাগুলোকে উতরে যেতে সাহায্য করেছিল। তাঁর এই সব ছবি ফেসবুকে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ শেয়ার করেন। এগুলোর মধ্যে নিজেদের জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা। ছবিগুলো প্রদর্শিত হয়েছিল বাংলাদেশ এবং কলকাতার বিভিন্ন প্রদর্শনীতে। পেয়েছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সেখান থেকেই এত দূর এসে আজকে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন ফারা।

স্টুডিও যাবে আপনার বাড়ি

স্টুডিওতে যাওয়ার বদলে স্টুডিওই যদি হাজির হয় আপনার দোরগোড়ায়—এই ভাবনা থেকেই ফারহানা ফারা বানিয়েছেন পোর্টেবল স্টুডিও। ক্লায়েন্টের প্রয়োজন অনুযায়ী হাজির হয়ে যান পুরো স্টুডিও নিয়ে। মডেল নির্বাচনের বেলায় তথাকথিত সৌন্দর্যের নিয়ম ভেঙে কাজ করতে পছন্দ করেন ফারা। নিজের প্রতিষ্ঠান এফ এ প্রোডাকশনের হয়ে করেন কনসেপচুয়াল, পোট্রের্ট, প্রোডাক্ট, গ্ল্যামার, বেবি ফটোগ্রাফি, মেটারনিটি ফটোগ্রাফি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফটোগ্রাফি, করপোরেট হেড শট, কোম্পানি প্রোফাইল, ফুড ফটোগ্রাফি।

অর্জন

দেশ ও বিদেশ মিলিয়ে মোট ২১টি গ্রুপ প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন ফারহানা ফারা। এর মধ্যে এসসিপিএফ ২০১৬-তে হয়েছেন প্রথম। ক্যারাভান অব ভিশন ২০১৬-তে প্রথম। ডি’মনোক্রোম ২০১৭-তে দ্বিতীয়। সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৮-তে রেকমেন্ডেড (পোর্ট্রেট ক্যাটাগরি)। পলিফোনি ফটো ফেস্টিভ্যাল ২০১৮-তে দ্বিতীয়৷ কান পেতে রই আয়োজিত ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা ইনট্রিগিং ইলিউশনস ২০১৮-তে দ্বিতীয় রানারআপ এবং অনারেবল মেনশন। রবি আয়োজিত ফটো আপলোডিং কনটেস্ট ২০১৯-এ প্রথম। একশন এইড আয়োজিত ভিন্নরূপে পুরুষ শীর্ষক প্রতিযোগিতা ২০১৯-এ প্রথম রানারআপ হন এই গুণী আলোকচিত্রী।