পরিপূর্ণ মানুষের ছবি

>
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০)
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০)
আনিসুজ্জামান তাঁর জীবন ও কর্মে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অভিভাবক। তিনি প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর বিপুল কীর্তি। গবেষণায়, শিক্ষকতায়, বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা আন্দোলনে। আরও রেখে গেছেন তাঁর জীবন ও কর্মের সংস্পর্শে আসা মানুষ। মনস্বী ও বিবেকী এই মানুষটির প্রতি প্রথম আলোর গভীর শ্রদ্ধা 


১৪ মে। সূর্য তখন অস্তগামী হওয়ার আভাস দিচ্ছে ঘড়িতে। আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা মুখে-হাতে পড়লো। দরজা-জানালা বন্ধ করার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, মোবাইলটা শব্দ করে জানান দিল সাজ্জাদ শরিফ কল দিয়েছেন। উত্তর দিতেই তিনি করুণ এবং বিধ্বস্ত স্বরে জানতে চাইলেন, ‘শুনেছেন তো আপা?’

আমার হৃৎপিন্ড মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। ধক্ধক্ করে উঠলে। বললেন তিনি, ‘স্যার আর নেই।’ বিকেল ৫টা বাজে তখন। বৃষ্টির পানি আর চোখের পানি একাকার হয়ে গেল। ‘স্যার’–এর জীবন প্রদীপ ৪টা ৫৫ মিনিটে (১৪ মে, ২০২০) নিভে যাওয়ায় প্রকৃতি কেঁদে কেঁদে বেদনা জানাল। আমাকে এবং বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সহমর্মী সবার মনে কান্না জাগিয়ে দিল। স্তব্ধ হয়ে রইলাম। স্যার অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু আকস্মিকভাবে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেবেন ভাবতেই চাইনি।

প্রায় বছর চার ধরে স্যারের সারা দিনের সুস্থতা-অসুস্থতা, খাওয়া, কাগজ পড়া, বই পড়া, বিশ্রাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা, নাতি-নাতনি, ছেলে-মেয়ে-বউমার সঙ্গে আনন্দ করা, কাছের মানুষদের ফোন ধরে কথা বলা—সব খুঁটিনাটি খবরাখবর জানাতেন আমাদের প্রিয় বেবী ভাবী। প্রায় রোজই রাত ১০টায় ভাবী আমাকে অথবা আমি ভাবীকে ফোন দিয়ে তাঁর এবং স্যারের কথা জানাতেন বা আমি জানতাম।

ভাবী কয়েক বছর ধরেই স্যারের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে চিন্তিত, ভাবিত, সক্রিয়। স্যারের প্রিয় ও পছন্দের খাবার ঘড়ির সময় ধরে ধরে তৈরি করা ও খেতে দেওয়া, ওষুধপত্র এগিয়ে দেওয়া—সব করতেন তিনি সহায়তাকারীদের সঙ্গে নিয়ে। সেই ভাবীর মুখটাই আমার মনকে অশ্রুভারাক্রান্ত করে দিল স্যারের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার খবরে।

ভাবীর গৃহকর্ম, আত্মীয়-স্বজনদের খুঁটিনাটি সাহায্য, অসুখে-আনন্দে ছুটে যাওয়া, সকলের কাজে সহযোগিতা—স্যারকে সংসারের দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল। চাকরি করে, সংসার সামলেছেন এবং ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন ভাবী। অনেক সময় স্যার একান্তে বলেছেন হেসে হেসে, ‘বেবী তো আমাকে মানুষ করেছে।’

ভেবে পাচ্ছিলাম না ভাবীর মুখোমুখি হব কীভাবে? কোভিড-১৯–এর ধাক্কায় বাড়ির বাইরে যাওয়ার বিপত্তিতে স্যারকে দেখতে যেতে পারিনি। বাড়িতে না, হাসপাতালেও নয়। সেই আফসোস জীবনভর থাকবে। অনেক ভেবে সন্ধ্যায় স্যারের ছোট মেয়ে শুচিকে ফোন দিয়ে কথা বলে ভাবীর সঙ্গে কথা বললাম। ভাবী কান্নাভেজা গলায় বললেন, ‘বলো তো, আমি কি তোমাদের স্যারের জন্য কিছু করতে পেরেছি?’

ভাবীকে বললাম, ‘বিয়ের পর থেকে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত আপনি স্যারকে যেভাবে সেবা-ভালোবাসা-মমতা দিয়ে আপ্লুত করে রেখেছিলেন, তার কোনো তুলনা হয় না। কষ্ট পাচ্ছেন, অবশ্যই পাবেন। কিন্তু আফসোসের জন্য কোনো ফাঁকই আপনি রাখেননি ভাবী।’

ভাবী কাঁদলেন। আমি কাঁদলাম। কথা না ফুরালেও দুজনের কাছ থেকে দুজনে বিদায় নিলাম। ফোন বন্ধ করলাম।

শত শত শিক্ষাবিদ-গবেষক-শিক্ষার্থী-সংস্কৃতিসেবী-বন্ধু-স্নেহার্থী স্যারের লোকান্তরে দুঃখ-বেদনা-কষ্ট পাচ্ছেন। কত স্মৃতি উজ্জ্বল সবার মনে। ‘ইতিহাস কথা কও,’ বলে উঠছে আমাদের প্রাণ।

স্যারের ৮০তম জন্মবর্ষ পালনের আয়োজক ‘চন্দ্রাবতী একাডেমী’র কর্মাধ্যক্ষ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খোন্দকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত স্যারের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আয়োজকদের কমিটির অন্যতম সদস্য রূপে যোগ দিতে পেরে ধন্য হয়েছি। ৬৩ জনের গদ্য, কবিতা, স্মৃতিচারণ, মূল্যায়ন ও গ্রন্থালোচনায় সমৃদ্ধ আনিসুজ্জামান সম্মাননা গ্রন্থটি স্মারকগ্রন্থ হিসেবে গবেষকদের কাছে সমাদৃত থাকবে।

আমার স্মৃতিতে স্যার উজ্জ্বল হয়ে আছেন কৈশোরোত্তীর্ণ সময় থেকে। আমার প্রয়াত ভাই আব্দুল হালিম-এর বন্ধুত্বের সূত্রে দূর থেকে তাঁকে জেনেছিলাম। আইএ পাশের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স ক্লাশে ভর্তি হলাম ১৯৬২ সালে। অষ্টাদশী আমি আনন্দে বিহ্বল হয়ে বিশিষ্ট গুণীজন ও শিক্ষকদের লেকচার শুনতাম। লাইব্রেরি যেতাম। স্যারদের মধ্যে কিছুটা পরিচিত ছিলেন আনিসুজ্জামান স্যার এবং ঘনিষ্ঠ পরমাত্মীয় ভাই ছিলেন মুনীর চৌধুরী। আকর্ষণ জাগিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন–আশ্রয়ী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। আনিস স্যার তখন ২৬ বছরের তরুণ। জ্ঞানে-গবেষণায়–অধ্যাপনায় কৃতী।

‘যৌতুক প্রথার সামাজিক রূপ ও বাংলা সাহিত্যে তার প্রতিফলন’ শিরোনামে আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয়ে তাঁর সম্মতি, পরামর্শ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে সমস্ত পদক্ষেপে তাঁর সরাসরি সহযোগিতা-পরামর্শ-পদক্ষেপ আমাকে বিহ্বল ও কৃতজ্ঞ করে রাখবে আজীবন। স্যারের বইগুলো পড়েছি, প্রতিটি বিষয়ে নির্দেশনা পেয়েছি, এখনো পেয়ে যাচ্ছি। কত হাসিঠাট্টার গল্পে তাঁন সঙ্গে অংশ নিয়েছি নিরব শ্রোতা হিসেবে।

স্ত্রী িসদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিতা জামান ও সুচিতা জামান এবং ছেলে আনন্দ জামানের  সঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
স্ত্রী িসদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিতা জামান ও সুচিতা জামান এবং ছেলে আনন্দ জামানের সঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

একটি দিনের স্মৃতি আমৃত্যু ভুলবে না। ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি। সন্ধ্যা ৬টায় স্যার ফোন দিয়ে জানালেন, ভাবীসহ আমাদের বাসায় আসবেন। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ‘স্যার, মতি তো বাসায় নেই।’ হেসে বললেন, ‘তুমি থাকলেই হবে।’ বাসায় যা ছিল, তা–ই দিয়ে হালকা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলাম। ভাবী ও স্যার এসে বসলেন। তাঁর সদ্য মুদ্রিত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (প্রথম প্রকাশ: কথা প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫) বইটির দুটো কপি দিয়ে বললেন, ‘দেখো তো।’ অবাক বিষ্ময়ে পাতা উল্টে দেখলাম:
উৎসর্গ
মতিউর রহমান
মালেকা বেগম
স্যার নাম লিখলেন, ১০.০১.১৫।
আমি স্যারকে সালাম করলাম। ভাবীকে জড়িয়ে ধরলাম। আমাদের জীবনে এই প্রাপ্তি গভীর সম্মানের। কৃতজ্ঞ আমরা।

স্যারের সঙ্গে কয়েকটি বই সম্পাদনার কাজে যুক্ত থেকে কৃতার্থ হয়েছি। গণসাহায্য সংস্থায় আমি কর্মরত ছিলাম নারী উন্নয়ন বশেষজ্ঞ হিসেবে, ১৯৯০–এর দশকে। তাদের উদ্যোগে প্রকাশিত নারীর কথা (১৯৯৪) ও ফতোয়া (১৯৯৭) বই দুটি সম্পাদনা করে আনন্দ পেয়েছি। আমার সম্পাদিত নির্বাচিত বেগম: অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছেন স্যার আমাকে কৃতজ্ঞ করেছেন। স্যারকে ও আমার পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নাজমা চৌধুরীকে উৎসর্গ করেছিলাম নারী আন্দোলনের পাঁচ দশক বইটি।

স্যারের কাল নিরবধি বইটির ইতিহাস–সমৃদ্ধ বিবরণ, পরিবারের বিস্তারিত ঘটনা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ—তেমনি সিদ্দিকা ভাবীর সঙ্গে পরিচয়, মধুর প্রেমের সূত্রপাত এবং বিয়ে ও সংসারের গল্প পড়তে পড়তে আনন্দ পাওয়ার কথা না বলে পারছি না।

স্যার কাল নিরবধি বইটি উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের বেবী ভাবিকে। উৎসর্গে লিখেছিলেন ‘সাত–পাঁচ ভেবে বেবীকেই’। স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সাত–পাঁচ ভেবে কেন? স্যার বেশ জোরে হেসে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বুঝে নাও নিজেই বুঝে নাও।’ তখন স্যার, বেবী ভাবি আর আমি প্রাণখোলা হাসিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিলাম।

আনিস স্যার সবার জীবনেই ব্যক্তিগত আনন্দের স্মৃতি ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর কথা বলে শেষ করার মতো নয়। বেবী ভাবীর সঙ্গে তাঁর প্রেম–ভালোবাসার বিচ্ছিন্নতা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঘটবে না। তিনি বেঁচে থাকবেন ভাবির হৃদয়ে, ছেলে–মেয়ে–নাতি–নাতনিদের মনে, তাঁর স্নেহধন্য সবার মনে।

গত বছর সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির আয়োজনে আনিসুজ্জামান স্যার, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার ও রাশেদা কে চৌধুরীকে সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানে তিনি যে আলোচনা করেছিলেন তা আমাদের—কর্তৃপক্ষ, শিক্ষকমণ্ডলী, ছাত্রী—সবার মনে গেঁথে আছে। তিনি বলেছিলেন, বহু সম্মাননা পেয়েছেন তিনি দেশে–বিদেশে, কিন্তু দেশে তিনি সম্মাননা পেয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

প্রাতঃস্মরণীয় রবীন্দ্রভক্ত ও রবীন্দ্রানুসারী, নারী–অধিকার ও রাজনৈতিক–মানবাধিকার–সচেতন গবেষণা–অধ্যাপনার গুণে গুণান্বিত আনিসুজ্জামান স্যার আমাদের সবার শ্রদ্ধাভাজন। লেখা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতা আমার হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মালেকা বেগম: গবেষক; শিক্ষক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি