পর্যটকদের গন্তব্য হয়ে ওঠার অপেক্ষায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

করোনার বন্ধের পর আবার সরব হয়েছে ক্যাম্পাস
ছবি: এম সাদেক

কোথাও উঁচু টিলা, কোথাও সমতল। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে ইট-কংক্রিটের একেকটি ভবন। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর, ছবির মতো সাজানো পরিপাটি প্রাঙ্গণ। ক্যাম্পাসের চারপাশ ঘিরে পর্যটন এলাকা। তাই শুধু শিক্ষার্থীরা নন, দর্শনার্থীরাও এখানে ভিড় করেন। লালমাই পাহাড়ের কোলে, প্রকৃতির মায়ায় ঘেরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস।

কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সালমানপুর গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ৫০ একর আয়তনের এ ক্যাম্পাসের বেশির ভাগজুড়েই টিলা। মূল ক্যাম্পাসের অদূরে নতুন করে একই মৌজায় আরও ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানেও সবুজে ঘেরা উঁচু উঁচু টিলা। আগামী পাঁচ বছরে এসব জায়গায় নানা ধরনের স্থাপনা গড়ার পরিকল্পনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য সরকার ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদনও দিয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড এই কাজ করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চোখজুড়ানো এক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হবে এই ক্যাম্পাস। তখন নিশ্চয়ই পর্যটকদের ভিড় বাড়বে আরও।

শিক্ষা ও সহশিক্ষা

২০০৭ সালের ২৮ মে প্রথম ব্যাচের ৭ বিভাগে মোট ৩০০ শিক্ষার্থী ও ১৫ শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। এখন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬টি অনুষদের ১৯টি বিভাগে আছেন ৫ হাজার ৯৬৫ শিক্ষার্থী ও ২৬৪ শিক্ষক। এ ছাড়া অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও কৌশল (সিএসই) ও ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) প্রোগ্রাম চালু আছে।

ক্যাম্পাসে মিলনায়তন নেই। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র নেই। ভালো মানের কোনো মাঠও তৈরি হয়নি। এত সব সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে শিক্ষার্থীরা কোলাহলে মাতিয়ে রাখেন পুরো প্রাঙ্গণ। মুক্তমঞ্চ, কাঁঠালতলা ঘিরে সৃজনশীল নানা কাজে অংশ নেন সংস্কৃতিপ্রেমী শিক্ষার্থীরা। প্রকৃতি থেকেই প্রেরণা নিয়ে কবিতার ছন্দ, গানের সুর আর আড্ডায় মশগুল থাকেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এখানে গড়ে ওঠে নাট্য সংগঠন থিয়েটার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবর্তন, আবৃত্তি সংগঠন অনুপ্রাস কণ্ঠচর্চা কেন্দ্র, ব্যান্ড প্ল্যাটফর্ম, কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি, সায়েন্স ক্লাব, প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠন অভয়ারণ্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফি সোসাইটি, স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন বন্ধু, উদীচী, প্রথম আলো বন্ধুসভা ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছায়া জাতি সংস্থা। এর বাইরে একেকটি বিভাগ নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি ঋতুভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে। বিতর্কে ও রোবট তৈরিতেও এখানকার শিক্ষার্থীদের সুনাম আছে।

ক্যাম্পাসে এক দুপুর

এক ভরদুপুরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ঘুরে প্রায় ৩০ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো। প্রাপ্তির সঙ্গে অপ্রাপ্তিগুলোর কথাও বললেন তাঁরা। শিক্ষকদের কারও কারও অভিমত—কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, নীতিমালা ও বিধিবিধান না মেনে চাপে পড়ে কাজ করা হচ্ছে। অনৈতিক সুবিধা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চর্চাও ক্রমাগত বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিলে দেড় দশকে এই ক্যাম্পাস আরও এগিয়ে যেত। শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির হুসেইন বলেন, পছন্দের লোক দিয়ে এ ক্যাম্পাসে বেছে বেছে কাজ হচ্ছে। দক্ষ লোকদের দিয়ে কাজ হচ্ছে না। এতে করে উন্নয়নে পিছিয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতি ও ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর ভর্তি হওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা এগুলো করবে না জানিয়ে অঙ্গীকারনামায় সই করেন। কিন্তু বাস্তবে সেটি নেই।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি দুলাল চন্দ্র নন্দী অবশ্য আশার কথাই বললেন। তাঁর বক্তব্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দেড় দশকে অনেক এগিয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, হচ্ছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা পাস করার পর সরকারি, বেসরকারি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানে ভালো করছেন। করোনার কারণে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কিছুটা স্থবির ছিল। এখন ধীরে ধীরে বাড়বে।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী

সব ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি: উপাচার্য

প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরে কতটুকু এগোল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়?

এমরান কবির চৌধুরী: দেখুন, ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। তখন প্রশাসনিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ছিল। যোগদানের পর আমি মহাপরিকল্পনা নিই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য মেগা প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। প্রায় চার বছরে এক দিনের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি হয়নি। পাঠদান রাজনৈতিক কারণে বন্ধ হয়নি। আমার সময়ে ১০০ নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। ২৬ শিক্ষক পিএইচডি করতে গেছেন দেশের বাইরে, তাঁদের মধ্যে ১৬ জন যুক্তরাষ্ট্রে। এ সময়ে নতুন চারটি বাস কিনেছি। সবাইকে নিয়ে কাজ করছি। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পর্যটকেরা এই ক্যাম্পাস দেখতে আসবেন।

গবেষণা কার্যক্রম কেমন চলছে?

এমরান কবির চৌধুরী: এখানে কোনো ধরনের গবেষণা কার্যক্রম ছিল না। ভাতা কম ছিল, পরিকল্পনাও ছিল না। এখন গবেষণা হচ্ছে। কমিটি করে দিয়েছি। কমিটি তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রস্তাবনা মূল্যায়ন করে গবেষণার অনুমোদন ও বরাদ্দ দেয়। নীতিমালা মোতাবেক গবেষণা শুরু হচ্ছে। যেসব বিভাগে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আছেন, তাঁরা পিএইচডি ও এমফিল কোর্স চালু করবেন। এখন ফি নির্ধারণের কাজ চলছে। গবেষণা বাড়ানো হবে।

নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হবে কবে?

এমরান কবির চৌধুরী: ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ দশমিক ৭০ একর জায়গা নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে একটু জটিলতা ছিল। সেটা নিয়ে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। ভূমি বরাদ্দের জন্য টাকাও বরাদ্দ এসেছে। এই প্রক্রিয়া শিগগিরই শেষ হবে। এরপরই কাজ শুরু হবে। সেনাবাহিনী মহাপরিকল্পনার নকশা মোতাবেক কাজ করবে।

ক্যাম্পাসে সহশিক্ষা কার্যক্রম কতটুকু হচ্ছে?

এমরান কবির চৌধুরী: এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যোগদানের আগে কোনো খেলাধুলা হতো না। আমি এসে ম্যারাথন দৌড়, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল ও হ্যান্ডবল খেলা চালু করেছি। এখন বাস্কেটবল গ্রাউন্ড হবে। বরাদ্দ এসেছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষার্থীরা ভালো করছেন। সায়েন্স ক্লাব রোবট বানাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিতর্কে ভালো করছেন। লাইব্রেরিতে জ্ঞানচর্চার সুন্দর পরিবেশ করা হয়েছে। নতুন ক্যাম্পাসে গেলে শিক্ষার্থীরা একাধিক খেলার মাঠ, সুইমিংপুল, টিএসসি ও এক হাজার আসনের মিলনায়তন পাবেন।