পলিমার ক্লের সৃজনশীল গয়না

ক্লে বা মাটির গয়নার সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অনেক আগে থেকেই। কিন্তু নতুন ধারার ‘পলিমার ক্লে’ গয়নার সঙ্গে আমাদের সখ্যের এক নতুন অধ্যায় তৈরি হয়েছে। এটা সত্য যে পলিমার ক্লে আসলে কোনো মাটি নয়। প্রকৃতি নয়, এর আসল উদ্ভব কারখানায়। সাধারণত কাঁচা অবস্থায় এটা নমনীয় থাকে। তাই সহজে যেকোনো ছাঁচে ফেলা যায় এবং বেকিং বা ফায়ারিংয়ের পর শক্ত হয়ে যায়। এই উপযোগী বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করেই নানা গুণী কারুশিল্পীর পাণ্ডিত্যের প্রকাশেই এ জুয়েলারিকে ট্রেন্ডে পরিণত করেছে।

পলিমার ক্লের তৈরি দুল
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং পদ্ধতিতে তৈরি পলিমার ক্লে মূলত পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি দিয়ে তৈরি। পিভিসিকে পরে প্লাস্টিসাইজারের সঙ্গে মিশ্রিত করার ফলেই নমনীয়তা আসে। এরপর যোগ করা হয় কালার পিগমেন্ট। পিভিসি পলিমারাইজের কারণে এ যৌগের নাম পলিমার ক্লে। ১৯৩৯ সালের দিকে জার্মান পুতুল ডিজাইনার কোথে ক্রুসে এই ফর্মুলার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হন এবং তাঁর মেয়ে ফিফিকের সঙ্গে পরিচয় করান। তার সঙ্গে বিখ্যাত ‘ফিমো’ কোম্পানি সম্পর্কিত। প্রথম দিকে এই ক্লে মূলত পুতুল, ভাস্কর্য বা বিভিন্ন ক্রাফট তৈরির কাজেই ব্যবহার করা হতো।

হাতের আঙুলে পলিমার ক্লের তৈরি আংটি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

পলিমার ক্লের তৈরি জুয়েলারিগুলো আমাদের বেশ আকর্ষণ করে। কারণ এগুলো প্রতিদিন পরার মতো। ফরমাল কিংবা ক্যাজুয়াল সব লুকের জন্যই যথাযথ। হালের ফ্যাশনসচেতন মানুষের বেশি আগ্রহ স্টেটমেন্ট, প্যাটার্নড আর মিনিমালিস্ট গয়নায়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা তাঁদের সৃজনশীলতায় শিল্পীর মনগড়া যত ডিজাইন আর প্যাটার্নে পলিমার ক্লে দিয়ে শিল্প তৈরি করেন; ঠিক যেন যেমন খুশি তেমন সাজাও টাইপ।

পিভিসি দিয়ে তৈরি দুল
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

ট্র্যাডিশনাল জুয়েলারির মতো একে খুব কাঠামোগত কঠোরতায় ভুগতে হয় না। বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে, বাহারি রং দিয়ে হাজারো পিগমেন্ট তৈরি করা যায় এই ক্লে দিয়ে। আবার কখনো কখনো মূল্যবান পাথর, মেটাল ব্যবহার করে ফ্লোরাল, স্টেটমেন্ট, প্যাটার্নড, এনিমেটেড, ক্রাফটেড, কন্টেমপরারি, মিনিমাল যেকোনো ডিজাইনের জুয়েলারি বানানো যায়। এক কথায় যাকে বলে ‘পরিধানযোগ্য শিল্প’, সেটা তৈরি করা যায়।

পলিমার ক্লের ব্রেসলেট
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

পলিমার ক্লে আর্টিস্ট ও ইনফ্লুয়েন্সাররা এ কাজকে এক আনন্দদায়ক শিল্পচর্চা ও পেশায় পরিণত করেছেন। তাঁরা হাজার ধরনের ম্যানিপুলেটিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন কিট বা টুলসের সাহায্যে ঘরে বসেই নিজস্ব শৈলী ও সৃজনশীলতা ফুটিয়ে তোলেন। এ ধরনের গয়নাগুলো ট্রেন্ডে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আনন্দদায়ক কাজকে উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে সৃজনশীলতার খেলায় পরিণত করা।

পলিমার ক্লে দিয়ে জুয়েলারি তৈরি করার বেসিক টিপস

ক্লে তৈরি: ক্রাফট শপগুলোতে ভালো মানের জুয়েলারি তৈরির পলিমার ক্লে কিনতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রঙের ক্লে আপনার পছন্দমতো কিনে নিতে পারেন। গয়না তৈরির জন্য প্রথমেই নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্লে হাতের তালুতে নিয়ে চাপ দিয়ে দিয়ে নরম করে নিতে হবে। এ কাজ ক্লে মেশিনে বা হ্যান্ড রোলার দিয়েও করা যায়। খেয়াল রাখতে হবে যেন ক্লের দলায় কোনো বাতাসের বুদ্‌বুদ না থাকে। এ ছাড়া আঙুলের ছাপ লেগে যাওয়ার ভয় থাকলে গ্লাভস ব্যবহার করে কাজ করাই ভালো। একটু আলাদা ধরনের ডিজাইন করার জন্য দুই বা তিন রঙের ক্লে, গোল্ড বা মেটালিক ফয়েল দিয়ে মার্বেলিং বা শেডিংও করা যায়।

পলিমার ক্লে দিয়ে তৈরি লকেট
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

শেপিং টুলস: পলিমার ক্লে ব্লেন্ডিং করার পর সঠিক শেপ আর ডিজাইনার জুয়েলারি তৈরিতেও বিভিন্ন টুলস লাগে। মেটাল টিউব বা পিভিসি রোলার, কাটিং ব্লেডস, ডিআইই কাটারস, ছাঁচ, স্ট্যাম্প, টেক্সটার শিট, মেটালিক পাউডার, রং বা কালি, সিলিকন, গ্লাস বা সিরামিক—ভঙ্গুর অংশগুলোকে আবার ফর্মে আনার জন্য।

বেকিং: ডিজাইন ও কাট করা পলিমার ক্লেগুলোকে বেক করার জন্য ইলেকট্রনিক ওভেন বেশ উপযোগী। এ ক্ষেত্রে ওভেনে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মেপে নেওয়া সবচেয়ে ভালো কাজ। সাধারণত ৪ ভাগের ১ ইঞ্চি পুরুত্ববিশিষ্ট পলিমার ক্লে ২৭৫০ ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ৩০ মিনিটে বেক করা হয়। আবার কিছু কিছু ব্র্যান্ডের প্যাকেজিংয়ে বেক করার নির্দেশনা দেওয়া থাকে। বেকিংয়ের জন্য আরেকটি টুল হলো হিটগান। বেক করার পর প্রোডাক্ট ঠান্ডা হলে মসৃণ করার জন্য পলিশ করার দরকার হলে স্যান্ডপেপার দিয়ে আলতোভাবে ঘষে নেওয়া ভালো।

পলিমার ক্লের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন আরও নানাকিছু
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

পলিমার ক্লের কানের দুল, ব্রেসলাইন, পেন্ড্যান্ট, পুঁতির মালাসহ আরও অনেক ধরনের গয়নায় তৈরির জন্য মূল ক্লে ছাড়াও ছোট ছোট আরও যন্ত্রাংশের দরকার হয়। যেমন কানের দুলের জন্য বেক স্টাড (হুক, হুপ), জাম্প রিং। এসব সংযুক্ত করার জন্য পছন্দ অনুসারে গ্লু, রেসিন বা পলিমার ক্লে ব্যবহার করা যায়।

পলিমার ক্লে দিয়ে তৈরি ইনস্টাগ্রামের লোগো
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

গ্লোসিং: গয়নাগুলোতে চাকচিক্য ভাব আনার জন্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বার্নিশ গ্লসিং ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তা ছাড়া রেজিনের কোট করেও জুয়েলারিগুলোতে উজ্জ্বল ভাব আনা যায়।

শখ ও সৃজনশীলতায় তৈরি পলিমার ক্লের অনবদ্য শিল্পকর্ম বর্তমানে অনলাইন বিজনেস ও ক্রাফট হাউসগুলোর মাধ্যমে বেশ পরিচিত পেয়েছে। শত শত ডিজাইন ও আইডিয়ার এসব গয়নায় কোয়ার্টজ বা মার্বেলিং ট্রেন্ডও আনা যায়। তা ছাড়া কখনো এস্থেটিক, কখনো কনটেমপোরারি, কখনোবা স্টেটমেন্ট ফ্যাশনেবল লুককে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলে।