পাঠক হাজির

আহত পাখির গান
চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার নিম্নমধ্যবিত্ত গ্রাম। উদাহরণ দেওয়ার মতো তেমন কোনো আইকন এখানে নেই। সহজ মানুষগুলো সরলভাবে জীবনটা যাপন করে। এখানে দুর্দান্ত কিশোরেরা দাপিয়ে বেড়ায়। বর্ষায় ভরে ওঠা বামনসুন্দর খালে জলের সঙ্গে তাদের মিতালি হয়ে ওঠে। কখনো স্রোতের বিপরীতে চিত সাঁতার দেওয়া কতগুলো শক্তিশালী মুখ, কিংবা ভেলায় দাঁড়িয়ে জলের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।
বর্ষা মৌসুমে ফুটবল মাঠে যেন জল-কাদার হোলি খেলায় মেতে ওঠে কিশোরেরা।
আপন নিয়মে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, দুপুরে বিছানায় মাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলা, ভলি খেলার আসর দেখতে গিয়ে সন্ধ্যার পরেও বাড়ি না ফেরা, একটি বল কিনে না দেওয়ার অভিমানে বাবার টাকা চুরি, মার খাওয়ার ভয়ে রাত হলেও ঘরে না ফেরা, চন্দ্রগ্রস্ত রাতে খড়ের গাদায় লুকোচুরি, কনকনে শীতের রাতে খেজুরের রস চুরি, ফাগুন-চৈত্রে অষ্টপ্রহর কীর্তনের সুর।
এমন দুর্দান্ত গ্রামেই আমার জন্ম। এমন দুরন্ত ছেলেদের সঙ্গেই আমার শৈশব কাটানো!
বাড়ি ছেড়ে আসার সময় আমার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। কিছুদিন পরপর বাড়িতে যাওয়া হতো বলে কৈশোরের অনেকখানি স্মৃতি জুড়ে আছে প্রিয় গ্রামটা।
এখন খুব কমই বাড়ি যাওয়া হয়। ওই বয়সী ছেলে–মেয়েদের দেখলেই আমি আমার শৈশব হাতড়ে বেড়াই।
বাড়িতে যাওয়ার পথে প্রায় দেড় কিলোমিটার আগেই সেই জায়গাটি, যেখানে ফুটবল খেলে আসার সময় ট্রাক উল্টে মরে যায় ৪৪টি দুরন্ত প্রাণ। এখানে এলেই আমার কলিজাটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওই জায়গাটিতে ওদের স্মৃতিতে যে সৌধ তৈরি করা হয়েছে, কখনো সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। প্রতিটি মুখ যেন আমাকে আমার শৈশব দেখিয়ে দেয়। এক অজানা হাহাকারে কেঁদে ওঠে আমার শৈশব-কৈশোর!
এখন তাদের চলে যাওয়ার ছয় বছর কেটে গেছে। এত দিনে তারা কেউ কেউ শৈশব পেরিয়ে কৈশোর কিংবা কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে।
স্বর্গে তারা আরও দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ওখানে নিশ্চয়ই মরে যাওয়ার ভয় নেই!
শুভাশীষ শর্মা
চট্টগ্রাম
এ-ই ঠান্ডা পানি...
মন্ত্রণালয়ে কোটেশন জমা দিয়ে ফিরছি। হাইকোর্টের সামনে গাড়ির অপেক্ষায় বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা দ্বিতল বাসে উঠেছি। গাড়ির দুচাকা ঘুরতেই শাহবাগের দীর্ঘ যানজটে আটকে গেল। একসময় চালক গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছেন।
হঠাৎ একজন নারীর কণ্ঠ কানে এল, ‘এ-ই ঠান্ডা পানি...এই পানি!’ জরাজীর্ণ কাপড়ে একজন মধ্যবয়স্ক নারী, মাথায় পানির বোতল। বাসের জানালায় ঘুরে ঘুরে পানি বিক্রি করছেন। একটু বাদে আমাদের বাসে উঠলেন। সামনের আসনের একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘পানি কত?’
-‘২০ টাকা মামা।’
-‘১৫ টাকার পানি ২০ টাকা?’
-‘মামা, ফ্রিজের পানি তো তাই ৫ টাকা বেশি।’
লোকটা এক বোতল পানি কিনলেন। তখন আমার মনেই হয়নি তেষ্টা পেয়েছে। বিক্রেতা নেমে যাওয়ার পর জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে ৫০ টাকার একটা নোট ধরে পানি চাইলাম। ততক্ষণে বাস চলতে শুরু করেছে। আমি জানালা থেকে মাথা বের করে বললাম, ‘খালা বাকিটা রাইখা দেন।’ বাস শিশুপার্ক থেকে শাহবাগ মোড়ে এসে পৌঁছেছে। একসময় আবিষ্কার করলাম পানি বিক্রেতা আবারও আমার জানালার কাছে। আমার হাতে বাকি টাকাটা দিয়ে চেনা ভঙ্গিমায় পানি বিক্রি করতে শুরু করলেন। আওয়াজ তুললেন—‘এ-ই ঠান্ডা পানি...’
এস এম নূরনবী
ঝালকাঠি, বরিশাল

অপ্রকাশিত
ঢং ঢং শব্দ করে ঘড়িটা বেজে উঠল।
রাত ১২টা বেজে গেছে। দাদার আমলের এই ঘড়িটা দিনে দুইবার এমন বিরক্তিকর শব্দে বেজে ওঠে।
দুই ঘণ্টা ধরে বিছানায় শুয়ে আছি, কিছুতেই ঘুম আসছে না। যা একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল, তা–ও ঘড়ির আওয়াজে কেটে গেল। আজ রাতটা কেন জানি অন্য রকম মনে হচ্ছে। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারবার নীলের কথা মনে পড়ছে।
কী সব ভাবছি আমি। নিজেরই হাসি পাচ্ছে। জানি, এখন নীলের কথা ভাবাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। তারপরও ভাবছি।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সে। শুনেছিলাম ওর বাবা নাকি সরকারি চাকরি করেন, আমাদের এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। তাই তারাও এসেছে। ভর্তি হতে নাকি বেশ ঝামেলা হয়েছিল। সে খুব নীরব থাকত। কারও সঙ্গে মিশতে পারত না। আমার সঙ্গে কোনো দিন তেমন কথা হয়নি। শুধু সেই বর্ষার দিনটা ছাড়া।
সেদিন নীল ছুটির সময় ক্লাস থেকে বের হতে গিয়ে, বেখেয়ালে আমার পায়ে পাড়া দিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য বলেছিল, ‘সরি’। আর আমি বিরক্ত হয়ে যখন তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। থাক সেসব কথা।
এসএসসি পরীক্ষার পর নীলরা চলে গিয়েছিল এখান থেকে। অনেক দিন আর কোনো খবর জানতাম না। অবশ্য এখনো জানি না। শুধু জানি, নীল এখন এই শহরেই থাকে। কয়েক দিন আগে একটি স্কুলের সামনে তাকে দেখেছি। কথা বলার মতো কথাও ছিল, কিন্তু সাহস ছিল না।
নওশীন রহমান
সিলেট
কোথাও তিনি নেই!
তখন লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার দিন। ক্লাস সেভেন কিংবা এইটে পড়ি। একদিন কার কাছ থেকে যেন মলাট ছাড়া এক বই হাতে এল। ভেতরের পাতায় বইয়ের নাম লেখা চলে যায় বসন্তের দিন। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
সেই শুরু। তারপর একের পর এক আলোর জগতে হেঁটে চলা। সাদামাটা একঘেয়ে চেহারার চাঁদের দিকে নতুন করে তাকানো। নিতান্ত আটপৌরে জ্যোৎস্না থেকে গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার উপলব্ধি। ক্লাসে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনা লিখতে গিয়ে ‘মিসির আলি’ হতে চাওয়া। গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে হঠাৎ নিজেকে হিমু ভেবে বসা। পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি। খালি পা। নিয়নবাতির শহর। হেঁটে চলা। একাকী।
শুভ্রর চশমা চোখে দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকানো। অথবা কোথাও কেউ নেই! কেবল আছেন বাকের ভাই। আর তাঁর হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দুপাট্টা মল মল বাজে...।
নির্লজ্জের মতো ধারাবাহিক প্রেমে পড়া তো তখনই! আজ নবনী তো কাল রূপা। পরশু মৃণ্ময়ী। হা হা হা। এই অদ্ভুত সুন্দর চরিত্রগুলোর প্রেমে না পড়ে কি উপায় আছে?
অথচ কী আশ্চর্য! সেই মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হওয়ার আগেই সময় ফুরিয়ে গেল। উনি চলে গেলেন। ৬৩ বছর বয়স কি এতটাই বেশি?
যখন নুহাশপল্লীতে গেলাম তখন তিনি নেই। বাকি সব আছে। লিচুগাছ, বৃষ্টিবিলাস, ভূতবিলাস, গাছের ওপর বাড়ি—সব। আর আছে দিঘি লীলাবতী।
এখনো প্রতি পূর্ণিমা রাতে গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার আলোয় চারপাশ অলৌকিক হয়ে ওঠে। কেবল জ্যোৎস্না পাগল সে মানুষকে কোথাও দেখা যায় না। কোথাও তিনি নেই!
উজ্জ্বল মণি
দিনাজপুর
সময়
অনামিকা চুপচাপ শুয়ে আছে। গায়ে পাতলা চাদর। পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকা। মাথার কাছে ওষুধের শিশি, ট্যাবলেট। অনামিকার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। আমি বিছানার কাছে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে অনামিকা স্মিত হেসে বলল, ‘সময় হয়েছে, তাই না?’
আমার পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। ‘সময় হয়েছে, তাই না?’ কথাটি অনামিকা এভাবে বলল কেন? যেন আমাকে তাচ্ছিল্য করছে তার কথাগুলো। অনামিকা কি তবে বুঝতে পারছে? বুঝতে পারছে যে খুব দ্রুত তার সময় ফুরিয়ে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে?
‘ওমা, এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলে যে, কী কী ছাইপাঁশ গিলতে হবে হাতে গুঁজে দাও।’ অনামিকা হাসে।
আমি একের পর এক ট্যাবলেটের পাতা ছিঁড়ে অনামিকাকে আরও কিছুটা সময় বাঁচিয়ে রাখার পথ্য সংগ্রহ করি। পানির গ্লাস হাতে তাকে ওষুধ খাইয়ে দিই। অনামিকা চুপচাপ বড়িগুলো গিলে নেয়। আগে ওষুধ খেতে চাইত না, ইদানীং আর প্রতিবাদ করে না। আগে সারা রাত আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত, আজকাল অনামিকা কাঁদতে ভুলে গেছে। শুকনো চোখে কেবল ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে, ডাক্তার শফিউল আলমের বেঁধে দেওয়া সময় ফুরিয়ে আসছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে অনামিকার দেহের খাঁচায় বন্দী সময়।
অনামিকা আর আমি, আমরা দুজনে চুপচাপ অনুভব করি, যেন একে অন্যকে প্রশ্ন করছি,
‘সময় হয়েছে, তাই না?’
রাফিউজ্জামান
শ্যামলী, ঢাকা