পাতার বাঁশি
খোলা আকাশের নিচে বিশাল মাঠের এক কোণে বসে আছি। সময়ের সঙ্গে সূর্যের তেজ বাড়ছে। আমার সঙ্গে যে তিনজন আছে, তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে উত্তেজনার কাছে তা পাত্তা পাচ্ছে না। মুঠোফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষায় আছি। অবনি ফেসবুক লাইভে এলেই কার্যক্রম শুরু হবে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যাদের বেছে নিয়েছি, তাদের কারও বয়সই ১২ বছরের বেশি হবে না। তবে তিনজনকে একত্র করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কয়েকবার রিহার্সাল করিয়েছি। নিজের জন্য কিছু না কিনলেও ওদের লাল-সাদা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছি। আজকের দিনে ওরাই আমার সঙ্গী। কাজটা শেষ হলেই ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে একসঙ্গে খাব।
ফেসবুকের সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। শেষবারের মতো ওদের প্রস্তুত হতে বললাম। মুঠোফোনের স্ক্রিনে অবনির ছবি ভেসে ওঠে। আমি তিনজনকে লাইনে দাঁড় করাই। ওরা একসঙ্গে গেয়ে ওঠে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো...এসো...’। অবনির চোখের কোণে অশ্রু। আমার চোখেও কি? আপাতত তা আড়াল করি। গানের পর বেলুন ওড়ানো হবে। সব কটিতেই বিভিন্ন রঙে অবনির নাম লেখা। কী দারুণ হতো, যদি সত্যিই এগুলো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অবনির কাছে পৌঁছে যেত!
এমন এক পয়লা বৈশাখেই অবনিকে প্রথম দেখি। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি। শরীরে তখনো গ্রামের গন্ধ লেগে আছে। মনটাও প্রায়ই বাড়ির জন্য উতলা হয়। ক্যাম্পাসের আচার-অনুষ্ঠান তেমন টানত না। রোজ সকালে নিয়ম করে পান্তা খাওয়ায় অভ্যাস আমাকে কেউ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে তা মুখে দিয়ে বছর শুরুর প্রস্তাব দিল, হেসেই উড়িয়ে দিলাম। তারপরও বন্ধুদের সঙ্গে তাল মেলাতেই শরিক হয়েছিলাম বর্ষবরণে। কে কী করছে তা পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত ছিলাম। সুন্দর করে সাজানো মঞ্চে গান শুরু হয়। সেদিন শিল্পীদের গানের চেয়ে সঞ্চালকের কথাতেই বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম। শুদ্ধ বাক্যের মাঝে কবিতার লাইন! আঞ্চলিকতার বৃত্ত ভাঙতে এমন কারও কাছে দীক্ষা নিলে মন্দ হতো না!
প্রকৃতি কিছু বিষয় মিলিয়ে দেয়। সেদিনের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করা অবনিকে দ্রুতই আবিষ্কার করি। তা-ও আমাদেরই ক্লাসে! জড়তা কাটিয়ে একসময় মুগ্ধতা ও ইচ্ছার কথা জানাই। অন্যদের মতো হেসে উড়িয়ে দেয় না। সেদিনের পর থেকে একটু একটু করে বদলে যাওয়ার পাঠ নিই। বৈশাখ আমাদের কাছে এনেছিল, পরের বর্ষবরণগুলো তাই ভিন্ন মাত্রা পায়। ওর ইচ্ছে ছিল, কোনো একদিন আমিও বৈশাখী মঞ্চে উঠব। কিন্তু গান-আবৃত্তিতে পারঙ্গমতার অভাবে হয়ে ওঠেনি। তবে একটা বিষয় ওকে মুগ্ধ করেছিল। পাতার বাঁশি। শৈশবে কচি পাতা ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে বাজানোর অভ্যাসটা অবনির জন্য ফিরে আসে। বৈশাখের প্রথম দিনে বিশাল কোনো মাঠকে আমরা মঞ্চ বানাতাম। অবনির ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র পাতার বাঁশি বেজে উঠত।
অনার্স শেষে আমি যখন চাকরিতে যোগ দিই, স্কলারশিপ নিয়ে অবনি বিদেশে পাড়ি জমায়। তারপর এটাই প্রথম বৈশাখ। অবনিকে চমকে দেওয়ার আয়োজন সফল হয়েছে কি না, জানি না। ওর কথা মতো আমাদের প্রিয় জায়গাটিতে গিয়ে বসি। আবার ফেসবুক লাইভে আসে ও। এবার বৈশাখী সাজে উপস্থাপনার সেই পুরোনো ঢঙে। এরপরের অংশে এমন কিছু ঘটবে ভাবিনি। কোথা থেকে অবনি কচি পাতা সংগ্রহ করেছে, তা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে নিজেই বাজাচ্ছে! সে শব্দে এই বৈশাখেও বিস্ময় আর মুগ্ধতা একাকার হয়ে যাচ্ছে।