পারভীন এখন রিকশা চালান ঢাকা শহরে

রিকশাচালক পারভীন আক্তার
ছবি: লেখক

দুপুর প্রায় ১২টা। রোদের তেজ বেশ। ব্যাটারিচালিত রিকশাটি থামিয়েই হাঁপাতে লাগলেন দুই সন্তানের মা পারভীন আক্তার। রিকশাচালকের সিটে বসে পানির বোতলের ঢাকনা খুলে ঢকঢক করে পানি পান করলেন। নিজে থেকেই বললেন, ‘সেই ভোর ছয়টার সময় বার হইছি, আগে একটু পানি খাইয়্যা লইলাম।’

২৪ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে কথা হলো পারভীন আক্তারের সঙ্গে। দুই বছর ধরে তাঁর পরিচয় ‘অটোরিকশাচালক’। বয়স কত? জানালেন ৩০ বছরের সঙ্গে আরও চার যোগ করতে হবে। ছেলের বয়স প্রায় ১০ বছর আর মেয়ের বয়স ৫ বছর। স্বামী আগে রিকশা চালাতেন, তবে দুই বছরের বেশি সময় ধরে অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারেন না।

রিকশা চালিয়ে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে পারভীন আক্তার হেসে জর্দা দেওয়া পান মুখে দিলেন। তিনি বললেন, ‘রিজিকের মালিক আল্লাহ। ৩০০ টাকা মহাজনরে দিমু, এরপর যা পামু তার মালিক আমি নিজে। যাত্রী কম পাইলে সেই দিন না হয় মাছ খাইতে পারলাম না, আলুভর্তা-ডাইল খাইলাম। আর যেই দিন ভাড়া বেশি পাই বাড়ি ফিরনের সময় ২০ টাকার মাছ না হয় মন চাইলে পুলাপাইনের লাইগ্যা মাংস কিন্যা নিয়া যাই।’

পারভীন আক্তারের মুখে ক্লান্তির ছাপ। তবে মুখে হাসি। বললেন, ‘মহিলা মানুষ রিকশা চালাই, মানুষ যে কত কথা কয়। আমি নাকি আকাম করি। আমি মানুষের কথায় কান দিই না।’

চালকের আসনে পারভীন আক্তার
ছবি: লেখক

পারভীন আক্তার ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে তাঁর বাড়ি কোথায়, মা–বাবা কে, কোনো কিছুই জানা নেই। পারভীনের ভাষায়, ‘রাস্তায় লাথি, উষ্টা খাইয়্যা খাইয়্যা এই পর্যন্ত আসছি।’ চকলেট বিক্রি, রাস্তায় ইটের টুকরা কুড়িয়ে বিক্রি করাসহ কত ধরনের কাজ যে করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকে থাকার একটি ঘর পেয়েছেন। তবে পারভীনের ঠিকানা নেই বলে স্বামীও সুযোগ পেলে কথা শুনিয়ে দেন। স্বামী অশান্তিও করেন। মাঝে মাঝে পুলিশ রিকশার চাকার হাওয়া ছেড়ে দেয়। পারভীন বললেন, ‘আমি মহিলা মানুষ। চাকার হাওয়া ছাইড়া দিলে এই রিকশা টাইন্যা নিতে কী যে কষ্ট করতে হয়।’

রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতাও শোনান পারভীন। একদিন একজন বাইকচালকের বাইকে একটু রিকশা লেগে যাওয়ায় ওই বাইকচালক রাস্তার মধ্যেই তাঁকে চড় মারতে থাকেন। তবে অন্য পুরুষ রিকশাচালকেরা পারতপক্ষে তেমন খারাপ কথা বলেন না বলেও জানালেন।

পারভীন আক্তার থাকেন সিপাহিবাগে আজিজ মিয়ার বস্তিতে। তাঁর দুঃখ একটাই, দৈনিক ৩০০ টাকা মহাজন বা মালিককে দিতেই হবে। এ টাকা দিতে না হলে বাড়ি ফেরার সময় ছেলেমেয়ের জন্য হয়তো প্রতিদিন না হলেও দুই দিন পরপর হলেও মাছ-মাংস কিনে নিতে পারতেন।

টাকাপয়সা জমিয়েছেন কি না, প্রশ্ন করলে আবার হাসলেন পারভীন। বললেন, ‘কিছুই জমাইতে পারি নাই। যা কামাই করি তা দিয়া ঘরভাড়া, খাওন খরচ দেওনের পর আর তো কিছু থাকে না। বুঝেন না, মহিলা মানুষ হইয়্যাও রিকশা চালাই, কম যন্ত্রণায় তো আর এই পথে নামি নাই। গার্মেন্টস বা বাসাবাড়ির কাজে গেলে বাচ্চা দেখব কে? তাই রিকশা চালাই। যখন সময় পাই বাড়ি গিয়া রাইন্দা বাইড়া আবার বাইর হই। ভোরে ভাত, ডাইল আর আলুভর্তা কইরা বাইর হইছি।’

কথা বলতে বলতেই মাথার ক্যাপ বা টুপিটা ঠিক করে নিলেন। যাত্রী নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।