পাহাড়-ঝরনার রাঙামাটি

পাহাড়ঘেরা ছোট্ট শহর। আছে হ্রদের বিশালতা। ঝরনার কলতান। নগরের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির এমন কাছাকাছি ছুটে যেতে কার না মন চায়। তাহলে আর বসে থাকা কেন? এবারের দুর্গাপূজা আর ঈদের লম্বা ছুটিতে বেরিয়ে পড়ুন রাঙামাটির পথে। জেনে নিন পর্যটন শহর রাঙামাটির আদ্যোপান্ত।
এ পথ যদি না শেষ হয়: পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে মনোরম যে কটি সড়ক রয়েছে তার মধ্যে আসামবস্তী-কাপ্তাই সড়ক অন্যতম। নিজস্ব বাহন থাকলে ঘুরে আসতে পারেন এ সড়ক। অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস ভাড়া করেও যেতে পারেন। সড়কটি নির্মিত হয়েছে পাহাড়ের চূড়া দিয়ে। ফলে যখন সড়ক দিয়ে যাবেন দেখতে পাবেন কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য। তবে সড়কটি বেশ আঁকাবাঁকা তাই গাড়ি চালাতে হবে সাবধানে।
ঝুলন্ত সেতু: কোনো ক্যালেন্ডার, পর্যটনের পোস্টার বা পত্রিকার পাতায় প্রায়ই শোভা পায় রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু। সেতুটি এখন ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’। রাঙামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের তত্ত্বাবধানে ঝুলন্ত সেতুটি পরিচালিত হয়। ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ এ সেতু কাপ্তাই হ্রদের পানির ওপর দুটি পাহাড়কে সংযুক্ত করেছে। শহরের শেষ সীমানায় পর্যটন এলাকায় ঝুলন্ত সেতুটি অবস্থিত। সেতুটি পার হয়ে পাহাড় বেয়ে কিছু দূর গেলে ডিয়ার পার্ক এলাকায় দেখা যায় আদিবাসী গ্রাম।
রাজবন বিহার: রাঙামাটি রাজবন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। এই ভবনের নির্মাণশৈলী এবং সাড়ে ৩৩ একর জায়গা বিস্তৃত শান্ত সবুজ বৃক্ষরাজি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ি এলাকায় ১৯৭৬ সালে রাজবন বিহার প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিদিন শত শত ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নরনারীসহ প্রচুর পর্যটক বনবিহার এলাকায় যান।
চাকমা রাজবাড়ি: রাজবন বিহারের দক্ষিণ–পূর্বে রাজদ্বীপ এলাকায় রয়েছে চাকমা রাজবাড়ি। কয়েক বছর আগে রাজার বাড়ি পুড়ে যাওয়ার পর আর নতুন করে নির্মাণ করা হয়নি। তবে রাজবাড়ি এলাকার স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। চারদিকে কাপ্তাই হ্রদবেষ্টিত রাজদ্বীপ এলাকা। কালের আবর্তে চাকমা রাজার প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক কমে গেলেও এখনো শোভা পাচ্ছে মোগলদের কাছ থেকে অধিগ্রহণকৃত কামান। চাকমা রাজাদের মধ্যে অন্যতম বিচক্ষণ রাজা হিসেবে পরিচিত ভুবন মোহন রায়ের মূর্তি।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাদুঘর: রাঙামাটি শহরের প্রবেশ মুখে ভেদভেদী এলাকায় রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট জাদুঘর। জাদুঘর ভবনের দ্বিতলজুড়ে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজা চাকমা, বোমাং ও মং রাজা, রাজপুত্র ও তঁাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত রাজকীয় পোশাক, তলোয়ার, কামান, তৈজসপত্র, দলিল–দস্তাবেজ রয়েছে জাদুঘরে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন রাজা ও তাদের বাৎসরিক খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠান রাজপুণ্যাহের আলোকচিত্র। রয়েছে বিভিন্ন সময়ের স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা, ঐতিহ্যবাহী নানা ডিজাইনের রূপা ও হাতির দাঁতের অলংকার ও পুঁিতরমালা। রয়েছে আদিবাসীদের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ নানা অনুষঙ্গ।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ স্মৃতিসৌধ : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ তাঁদের একজন। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল নানিয়ারচরের বুড়িঘাট এলাকার যুদ্ধে তিনি নিহত হন। এ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং অবদানকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৭ সালে তাঁর শাহাদাতবরণ স্থানে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ। রাঙামাটি শহর থেকে নৌপথে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে স্বচ্ছ জলরাশি বেষ্টিত ছোট একটি দ্বীপে রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ স্মৃতিসৌধ।
ঝরনার পরশে : রাঙামাটি শহর থেকে নৌপথে যেতে পারেন সুবলং ঝরনায়। ঝরনা দেখার পাশাপাশি আপনার হয়ে যাবে আনন্দময় নৌ ভ্রমণ। এ ঝরনার নাম দেশের পর্যটকদের কাছে ইতিমধ্যে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। বরকল উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঝরনার আশপাশ এলাকায় কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার স্বচ্ছ জলরাশি পর্যটকদের আকর্ষণ করবেই। রাঙামাটি শহর থেকে ট্রলার ভাড়া করে যেতে হয় সুবলং ঝরনায়। রিজার্ভ বাজার ও তবলছড়ি লঞ্চঘাট এবং বনরূপার দেওয়ান পাড়ার সমতা ঘাট থেকে সুবলং ঝরনায় যাওয়ার ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। ।
আদিবাসী খাবার: অনেক পর্যটক আদিবাসী খাবার খেতে চান। আবার অনেকের আদিবাসী খাবার প্রিয়। আদিবাসী খাবার খেতে চাইলে যেতে পারেন রাজবাড়ি সড়কের ‘সাবারাং রেস্টুরেন্ট’। তার পাশেই রয়েছে ‘টুগুন’। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের পাশে হাসপাতাল সড়কের বিপরীতে রয়েছে ‘কেবাং’। বনরূপা হ্যাপির মোড় এলাকায় রয়েছে ‘দি রুপ’ এবং পোড়াভিটা এলাকায় ‘আইরিস’। বৈচিত্র্যপূর্ণ আদিবাসী খাবারের জন্য অগ্রিম ফরমায়েশ দেওয়া ভালো।
বেসরকারি পর্যটন : রাঙামাটি শহর থেকে নৌপথে সুবলং আসা–যাওয়ার পথে ‘পেদা টিং টিং’ ও ‘চাং পাং’ নামের দুটি বেসরকারি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এই দুটি পর্যটন স্পটে আপনি বিশ্রাম এবং খাবার খেতে পারেন। এ দুই কেন্দ্র থেকে সামান্য দক্ষিণ–পূর্বে রয়েছে ‘টুক টুক ইকো ভিলেজ’। এ ইকো ভিলেজের প্রায় ৩৫ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে ছোট ছোট টিলা। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশে সময় কাটাতে চাইলে যেতে পারেন টুকটুক ইকো ভিলেজ।
ওই দূর পাহাড়ে: পাহাড়ের চড়া যাঁদের শখ , তাঁরা যেতে পারেন পাহাড় আর ঝরনা দেখতে। এর মধ্যে ঘাগড়া বড়ইছড়ি সড়কের ওয়াগ্গা সাপছড়ি ছড়া ও সাপছড়ি মোন আদামে ঘুরে আসতে পারেন। সাপছড়ি মোন আদামের চূড়া থেকে রাঙামাটি শহর ও কাপ্তাই হ্রদের একাংশ এবং চট্টগ্রাম শহর দেখা যায়। যেতে পারেন ঘাগড়া কলাবাগানের পূর্ব পাশের পাহাড়ি ঝরনা দেখতে। এ ঝরনাটি চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়কের খুবই কাছে হলেও এখনো অনেকের অজানা রয়ে গেছে।
এ ছাড়া রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের উত্তর পাশে যে বড় পাহাড়টি দেখা যায়, সেটির নাম ফুরোমোন। বন্ধুবান্ধব মিলে যেতে পারেন ফুরোমোনের চূড়ায়। দুই দিকেই এ পাহাড়ে ওঠা যায়। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের দিকে থেকে জিপ বা মোটরসাইকেলে করে যেতে পারেন চূড়ায়। পাখির চোখে প্রকৃতিকে দেখতে হলে ফুরোমোন ছাড়াও যেতে পারেন ফালিটাঙ্যা মোন। সুবলং থেকে পূর্বে সবুজ বনানীতে আচ্ছাদিত বড় যে পাহাড়টি দেখা যায়, সেটিই ফালিটাঙ্যা মোন।
কীভাবে যাবেন : ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বাসে রাঙামাটি যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহনের দিবা ও নৈশবাস রাঙামাটি আসা– যাওয়া করে। ঢাকার পান্থপথ, কলাবাগান ও ফকিরাপুল থেকে বাস ছাড়ে। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় ও বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে রাঙামাটির বাস ছাড়ে।
কোথায় থাকবেন: রাঙামাটি শহরে থাকার অভিজাত স্থানগুলোর মধ্যে পর্যটন মোটেল, হোটেল সুফিয়া ইন্টারন্যাশনাল, গ্রিন ক্যাসেল ও হোটেল সাংহাই। এ ছাড়া রিজার্ভ বাজার, পুরাতন বাসস্ট্যান্ডসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আবাসিক হোটেল।