পাহাড়ের প্রথম দোল দোল দুলুনি

রাজস্থলী ঝুলন্ত সেতুছবি: রাকিব কিশোর

অফিসের কাজে কয়েক দিন ধরেই বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে ঘুরঘুর করছিলাম। সেদিন দুপুরের পর কক্সবাজার চলে যাব, সকালটা হাতে আছে। আগের দিন যে অদেখা রাজস্থলীর খোঁজ জেনেছিলাম, সাতসকালে রাঙামাটির এই ছোট উপজেলাটির পথে পা বাড়ালাম।

বান্দরবান শহর থেকে সিএনজি অটোরিকশায় চলে এলাম বালাঘাটা। এখান থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। যাত্রীর আশায় কুয়াশামোড়া ভোরেও কয়েকজন বাইকার বসে আছেন। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজস্থলী যাবেন? শুধু তিনি নন, বুঝলাম সব বাইকারই যেতে আগ্রহী! তাই ভাড়া নিয়ে রীতিমতো নিলাম হলো। ৯০০ টাকায় একজন জিতে নিলেন।

গাড়িবিহীন এই রাস্তাটা আর দশটা রাস্তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা
ছবি: লেখক

মোটরবাইকে চলতে চলতে জানলাম, চালকও আগে কখনো রাজস্থলী যাননি। কী একটা অবস্থা, টাকা আমি দেব, আর নতুন জায়গা দেখবেন তিনি! যাহোক, বান্দরবান থেকে কাপ্তাই রোডটা অসম্ভব সুন্দর। সকালের নতুন রোদে কুয়াশামাখা পাহাড়ের ঘোলাটে সবুজ সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে পেছনে। পকেট থেকে হাত বের করা যাচ্ছে না ঠান্ডায়। এককণা ধুলাও নেই, জনশূন্য পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলছি আমরা। এভাবে টানা ঘণ্টাখানেক চলার পর দুধপুকুরিয়া অভয়ারণ্যের সামনে এসে থামলাম। ভেতরে ঢোকার লোভ সামলে শুধু দুটি ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম। দুধপুকুরিয়া পার হওয়ার পরেই হুট করে চারপাশের দৃশ্যপট বদলে গেল। যত দূর চোখ যায় কোথাও কোনো পাহাড় নেই, সমতলের বিস্তীর্ণ ধানখেত। কে বলবে এটা পার্বত্য এলাকা!

রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া এসে ডান দিকে ঢুকে গেলাম আমরা। এখান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ গেলেই রাজস্থলী উপজেলা সদর। বাজার, মানুষ, কোলাহল, ধুলা আর গাড়িবিহীন এই রাস্তাটা আর দশটা রাস্তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তা হলেও এই রাস্তাটা পাহাড়ের একেবারে মাথার ওপর দিয়ে উঠে গেছে। ডানে তাকালে নিচে পাহাড়, বাঁয়ে তাকালেও নিচে সবুজ, সামনে যত দূর চোখ যায় সূর্যের আলোয় সোনালি হয়ে উঠেছে অচেনা সবুজ, আর পেছনে মনে হচ্ছে আস্ত বনভূমিটাই ছুটে আসছে ধরার জন্য। গুগল ম্যাপে দেখলাম চলে এসেছি প্রায়। উপজেলা অফিস পার হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম রাজস্থলী বাজার কোন দিকে? তিনি হাত এক দিকে তুলে বললেন, ‘ওই হোতা!’

রীতিমতো দুলতে দুলতে পার হতে হয় রাজস্থলী ঝুলন্ত সেতু
ছবি: লেখক

তাঁর দেখানো নির্দেশিত পথেই পাহাড় বেয়ে কিছুক্ষণ আগে নেমে এসেছি আমরা। কাজেই শোনা কথায় কান না দিয়ে সামনে এগোচ্ছিলাম আমরা। এগোতেই চক্ষু চড়কগাছ—এ যে দেখি একটা ঝুলন্ত সেতু! এখানে এই জিনিস। কী সুন্দর করে হেলেদুলে মানুষ পার হয়ে যাচ্ছে এপার থেকে ওপার।

পরে জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে জেনেছি, কাপ্তাই খালের ওপরে রাজস্থলী বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা প্রায় ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যের সেতুটিই বাংলাদেশের প্রথম ঝুলন্ত সেতু। ১৯৮৭ সালে শুধু কাঠ আর মোটা তার দিয়ে কী সুন্দরভাবেই না তৈরি হয়েছিল এই ‘দোল দোল দুলুনি’! দেশের অন্য যেকোনো ঝুলন্ত সেতুর চেয়ে এই সেতুর দুলুনি আলাদা, লোকজন মাতালের মতো টলতে টলতে হাঁটছে, হাঁটতে হাঁটতে একবার এপাশের সীমানায় বাড়ি খাচ্ছে তো আরেকবার ওপাশের তারের দেয়ালে ঢলে পড়ছে। আমিও ভিড়ে গেলাম, হাঁটতে হাঁটতে ঘুম চলে আসে এমন দুলুনি, চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে দোলনায় দুলছি! ঝুলন্ত সেতুর একেবারে মাঝবরাবর নিচে কাপ্তাই খালের স্বচ্ছ পানি, ওপাশে রাজস্থলী মূল বাজার। সেদিন ছিল হাটবার, ফলে নানা রকমের পাহাড়ি ফল-ফসলের সঙ্গে নাম না–জানা অজস্র জিনিসও বিক্রি হচ্ছে, এখান থেকে ইউনেক্স পরিবহন নামে একটা গাড়ি চন্দ্রঘোনা যায়, সেখানে সব ফসল যায়।

ঝুলন্ত ব্রিজটা সর্বশেষ ২০১৯ সালে সংস্কার করা হয়েছে
ছবি: লেখক

যেভাবে যাবেন

রাজস্থলী ঝুলন্ত সেতু দেখার জন্য সবচেয়ে সহজ হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই রোড ধরে চন্দ্রঘোনা যাওয়া। এখানে নেমে ৫ টাকায় ফেরি পার হয়ে বাঙ্গালহালিয়া থেকে সিএনজি বা স্থানীয় পরিবহনে চলে আসা। এখানে থাকার জায়গা নেই, ভালো খাবার হোটেলও নেই। দিনে এসে দিনে চলে যেতে হবে।

ঝুলন্ত ব্রিজটা ২০১৯ সালে একবার সংস্কার করা হয়েছে, ফলকে সেটা গোটা গোটা হরফে লেখা আছে। সংস্কারের পর এখন দুপাশে মোটা জালি তার দিয়ে খুব সুন্দর করে গলাসমান উঁচু করে তুলে দেওয়া হয়েছে, ফলে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। সেতু থেকে নিচে নেমে খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম সেতুটা। কী বিস্ময়!