পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙতে সোচ্চার ‘ঋতু’

প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ঋতু’। পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙতে সোচ্চার সামাজিক এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাঁরা প্রকাশ করেছেন কমিক বই, স্কুলে-গ্রামে হাজির হচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা, আয়োজন করে চলেছেন সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি।

পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙতে স্কুলে-গ্রামে হাজির হচ্ছেন ঋতুর স্বেচ্ছাসেবকেরা
ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ সালের শেষ দিকের কথা। চাকরি ছেড়ে ‘ঋতু’ নিয়ে পুরোদমে মাঠে নেমেছেন উম্মে শারমিন কবির। পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে ঢাকায় আয়োজন করছেন বিভিন্ন কর্মশালা। এমনই একদিন রাজধানীর একটি স্কুলে হাজির হলেন দলবলে। স্কুলের অফিসকক্ষে গিয়ে অনুমতি চেয়ে বললেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান। উপস্থিত শিক্ষকেরা ‘বিষয়টি’ জেনে অস্বস্তি ও সংকোচের সঙ্গে অধ্যক্ষ আসা পর্যন্ত বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। একসময় অধ্যক্ষ এলেন। দেখা করে যখন পিরিয়ড নিয়ে কথা বলবেন জানালেন, তাঁর অভিব্যক্তিতেও ফুটে উঠল, এসব নিয়ে আবার কেন কথা বলা! অনুমতি না পেয়ে সেদিন মন খারাপ করে বেরিয়ে এসেছিল ঋতুর স্বেচ্ছাসেবক দল।

তবু হতোদ্যম হননি শারমিন কবির। আবার গিয়েছিলেন সেই স্কুলে। শিক্ষকদের বুঝিয়েছেন বিষয়টির গুরুত্ব। এরপর তো হাসিমুখে হাজির হয়েছিলেন বয়ঃসন্ধিতে উপনীত শিক্ষার্থীদের সামনে। খোলামেলা কথা বলেছিলেন পিরিয়ড কী, কেন হয়, পরিচর্যাসহ বয়ঃসন্ধিকালীন নানা বিষয়ে। এভাবে দিনে দিনে প্রায় ৪০০ সেশনের আয়োজন করেছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ঋতু। স্কুলে যেমন হয়েছে, তেমনি গ্রামে, বস্তিতেও হয়েছে এসব আয়োজন। মাসিকসহ বয়ঃসন্ধিকালীন সচেতনতার বার্তা পেয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কিশোরী।

ঋতুর প্রতিষ্ঠাতা শারমিন কবির
ছবি: সংগৃহীত

ঋতুর শুরু

শারমিন কবির তখন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির একজন কর্মী। বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়েদের নিয়েই তাঁর কাজ। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেন, মেয়েরা বিভিন্ন সময় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, ক্লাসে মনোযোগ হারায়, বন্ধ করে দেয় স্কুলে আসা। এই কিশোরীদের মধ্যে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর এক গ্রামে কাটানো নিজের কৈশোরকে দেখতে পেলেন শারমিন। ‘আমি যখন কিশোরী ছিলাম, তখন কেউ আমার সঙ্গে বয়ঃসন্ধি কী, মাসিক কী—এই কথাগুলো বলেননি। ফলে বড় হয়েছি একদম না জেনে। আমার প্রথম পিরিয়ড হয়েছিল অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। গ্রাম থেকে মফস্বল শহরে গিয়েছি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে। আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি। রক্ত দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিলাম। হাতে ন্যাপকিন তুলে দিয়েছিল আমার বোন। আর কিছু বলেননি।’

নিজে নিজে ঠেকে ঠেকে বুঝেছেন শারমিন কবির। প্রথমবার প্যাড পরতে গিয়ে সঠিক ব্যবহারবিধি না জানায় অস্বস্তিতে ভুগেছেন। একটা সময় ‘মুড সুইং’য়ে ভুগতেন। মন খারাপ দেখে তাঁর মা হয়তো টাকা হাতে ধরিয়ে বলতেন কিছু খেয়ে নিতে। নারীর জীবনের প্রাকৃতিক এই পরিবর্তনকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা তাঁকে কষ্ট দিত। লুকিয়ে সংকোচে দিন কাটানোর যে ধারা চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। এই প্রজন্মও কি মাসিক নিয়ে এমন বিরূপ একটা চিন্তা নিয়ে বেড়ে উঠবে? শারমিন তখন চিন্তা করেন তিনি কিশোরীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো গল্পে গল্পে মাসিক, বয়ঃসন্ধি নিয়ে কথা বলবেন। মাসিক নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণাগুলো আছে, সেগুলোকে ধীরে ধীরে ভাঙবেন। ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে ঋতু।

ঋতু তৈরি করেছে স্যানিটারি প্যাড
ছবি: সংগৃহীত

শারমিন যোগ করেন, ‘বিভিন্ন এলাকায় মাসিক বা পিরিয়ড শব্দটা ঋতু হিসেবেও প্রচলিত আছে। আমাদের কাজের প্রতিফলন ঘটে এমন ভাবনা থেকেই প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা ঋতু ঠিক করি।’

‘ঋতু’র কাজ সম্পর্কে জানেন এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডে বিপণনপ্রধান (হাইজিন প্রোডাক্ট) মিজানুর রহমান। তিনি বলছিলেন, ঋতুর মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন পিরিয়ড নিয়ে সচেতনতার কাজ করছে, এসএমসির জয়া ব্র্যান্ডও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানা ও স্কুলে মেয়েদের সচেতন করে। এর ইতিবাচক প্রভাব সার্বিকভাবে লক্ষ করা যায়। পাঁচ বছর আগের তুলনায় হাইজিন পণ্যের ব্যবহার বর্তমানে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। তারপরও ৭৩ শতাংশ নারী অস্বাস্থ্যকর পিরিয়ডকালীন পণ্য ব্যবহার করছেন। তাঁদেরও সচেতন করতে হবে।’

জানতে হবে সবার

নারীদের জন্য পিরিয়ড একটি অনিবার্য সত্য। অথচ বিষয়টিকে রীতিমতো নিষিদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সমাজে। শারমিন কবির ভাবলেন, পিরিয়ড সচেতনতা শুধু মেয়েদের জন্য নয়, সচেতন করতে হবে পুরুষদেরও। ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাইকে সচেতন করতে শুরু থেকেই ভিন্নধর্মী কর্মসূচি পালন করছে ঋতু দল। সারা দেশে ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক এসব কর্মসূচির কান্ডারি। কোনো কিশোরীর প্রথম পিরিয়ড হলে, স্কুলে তা উদ্‌যাপনের রেওয়াজও তারা চালু করেছে। আবার অভিভাবকদের সচেতন করতে ‘কাউন্সেলিং ফর প্যারেন্টস’ নামের কর্মসূচির মাধ্যমে কিশোরীদের সঙ্গে বয়ঃসন্ধির ব্যাপারগুলো নিয়ে কীভাবে আলোচনা করবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেয় ঋতুর অভিজ্ঞ টিম।

শারমিন কবির বলেন, ‘এসব কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছে। ট্যাবু ভাঙছে। পিরিয়ড নিয়ে কথা বলার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আমার নিকটজনেরাও এখন খোলামেলা কথা বলেন। পিরিয়ডকালীন পরামর্শের জন্য সন্তানদের আমার কাছে পাঠান। কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল না।’

ঋতু কমিক

পিরিয়ড নিয়ে সচেতন করতে একটি কমিক বই প্রকাশ করেছে ঋতু। ঋতু কমিক বই নামের প্রকাশনায় বয়ঃসন্ধি, মাসিক, শারীরিক পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় সহজবোধ্য ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। বইটিতে বিভিন্ন বয়সী চার নারীর আলাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন কুসংস্কার ও দ্বিধার কথা বলা হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারবিধি থেকে মাসিকের দিনপঞ্জিকার নিয়মও শেখানো হয়েছে। গল্পের ছলে উঠে এসেছে মাসিকের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ। ইএমকে সেন্টারের অর্থায়নে বইটি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের একুশে বইমেলায়।

শারমিন কবির বলছিলেন, ‘কিশোরীরা তো বটেই, অভিভাবকেরাও কমিকটির প্রশংসা করেছেন। ৮ হাজার কপি বই বাংলাভাষী কিশোরীদের কাছে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি। বইটি আমরা চাকমা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছি।’