গতকালের প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় একাধিক ধর্ষণের খবর রয়েছে। নরসিংদী সদর উপজেলায় মো. আবদুল্লাহ (২৩) নামের এক রাজমিস্ত্রির বিরুদ্ধে ৬ বছর বয়সী এক শিশুকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে এবং মামলা করা হয়েছে। ঘটনার সময় শিশুটি রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড় ঘরে আনার জন্য ছাদে গিয়েছিল। কাপড় নিয়ে ঘরে ফেরার সময় চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়।
এর পরের ঘটনাটি আরও ভয়াবহ। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী কক্সবাজারে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা। গত ২৮ জানুয়ারি তিন দুর্বৃত্ত কিশোরীকে কক্সবাজারের একটি সড়ক থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। সেদিন রাতেই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে মাইক্রোবাসের মধ্যেই কিশোরীর হাত-পা বেঁধে একবার ধর্ষণ করে। এর পরদিন রাতে সেখান থেকে তিন দুর্বৃত্ত ওই কিশোরীকে কক্সবাজারের ঈদগাঁও কলেজ মাঠে এনে আরেকবার ধর্ষণ করে। ৩০ জানুয়ারি ঈদগাঁও বাজারের একটি মার্কেটের দোতলায় আটকে রাখা হয় কিশোরীকে। (সূত্র: প্রথম আলো, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।
পত্রিকাতে আরও একটি খুব মন খারাপ করা ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা পড়তে হয়েছে। মেয়েটি ছোটবেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করত। ক্যাম্পাসের অনেকেরই কাছেই পরিচিতি। তার মৃত্যুর খবর অনেককে বিচলিত করেছে। বান্ধবীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসেছিল সেই মেয়েটি। মেয়েটিকে কেউ একজন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে ডেকে নিয়ে যায় এবং তেলশা মাজারের কাছে ধর্ষণ করে এবং গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে। মেয়ের সঙ্গীরা তাকে খুঁজতে খুঁজতে তেলশা মাজারের কাছে যায়। সেখানে গলায় ওড়না পেঁচানো ও বিবস্ত্র অবস্থায় তারা তাকে উদ্ধার করে। কাছেই আবুল খায়েরকে তারা পোশাক পরতে দেখে। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে মারধর করে পুলিশে খবর দিলে তাঁকে আটক করে পুলিশ। (সূত্র: প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০২১)।
শুধু এই তিন–চারটি ধর্ষণই নয়, আমরা নিশ্চিত জানি প্রতিদিন এর চেয়েও অনেক বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং খুব কম ধর্ষণের বিচার চেয়ে মামলা হয়।
কয়েক দিন আগে কলাবাগানে এক কিশোরীকে ধর্ষণ–হত্যার ঘটনায় অভিভাবক মহলসহ অনেককেই আলোচনা, অস্বস্তি এবং দুশ্চিন্তায় ফেলেছ। তার পরপরই এই ধর্ষণগুলো নিয়েও তর্কবিতর্ক হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্নভাবে। সেখানে কয়েকটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েদের নিয়েই আলোচনা বেশি। তবে এবারের আলোচনাগুলো আর নারীর কাপড়চোপড়ের মধ্যেই নেই। ডালপালা মেলছে অনেকখানিই। মেয়েটি কেন গিয়েছিল খালি বাসায়? যেখানে শুধু ছেলেরাই ছিল। অনেকে বলছেন, ছেলেটি তাকে তার বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়নি মেয়েটি নিজেই গিয়েছিল। মেয়েটির বন্ধুবান্ধবের বয়ান উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক যেহেতু ছিল তাই এটি নিয়ে বলার কিছু নেই। এই শারীরিক সম্পর্কে মেয়েটির সম্মতি ছিল। মেয়েটির বয়স নিয়েও কথাবার্তার শেষ নেই। এরপরের বিষয়টি হচ্ছে অভিভাবকদের দায় ও দায়িত্বের বিষয়টি। এখানেও মুখ্য হয়ে উঠেছে মেয়ের মায়ের কথা। মেয়ের মা কেন মেয়েটিকে একা ছেড়েছিল? কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুল বিক্রেতা মেয়েটির মা কেন তাকে রাতে বের হতে দিয়েছিল বান্ধবীর সঙ্গে?
এখানে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টতই বলা প্রয়োজন, যখন আপনি বলবেন মেয়েটি কেন গেল? তার মানে কিন্তু এই বিষয়টির আপনি অনুমোদন দিয়ে দেন যে বাংলাদেশে এখন এই অবস্থা যে যে কেউ কারও বাসায় গেলেও ধর্ষিত হতে পারে। আর এই কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে সম্পর্কের ঘেরাটোপে ধর্ষণ বৈধ হয় না। বিশ্বজুড়ে যেখানে বেশির ভাগ দেশে খোদ ‘ম্যারিটাল রেপ’ নিয়েই আইন রয়েছে এবং বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি নিয়ে বড়সড় আলোচনা চলছে, তাই সম্পর্কের দোহাই এখানে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এখন বাস্তবতায়, নারীর প্রতি নিপীড়ন যখন এই মাত্রায় হচ্ছে তখন আসলে কী করণীয়? নারীকে ঘরে আটকে রাখবেন? নজরদারিতে রাখবেন? যেগুলো হয়তো এরই মধ্যে অনেক অভিভাবক শুরু করেছেন।
না। সেগুলো কোনোটিই সমাধান নয়। রাষ্ট্রের কাছে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা যেমনভাবে জোরালোভাবে চাইব, এর পাশাপাশি অভিভাবকদের বলব, সন্তানদের আচরণের ওপর নজরদারির বাইরে গিয়ে তাদের সম্পর্ক, নিপীড়ন, আইন, যৌনশিক্ষা, মানবিকতা, পারস্পরিক সম্মানবোধ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই আলোচনা করুন। সম্পর্কের মধ্যেও কী কী ধরনের নিপীড়ন থাকতে পারে, সেই বিষয়গুলো নিয়েও কথা বলতে হবে অনেকটাই। সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকের দূরত্ব এবং ডিজিটাল জগতের প্রতি অতিনির্ভরশীলতাও হয়তো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। নারীকে ঘরের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার বিপরীতে পুরুষতান্ত্রিক গর্ত এবং খাদগুলো সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য রাখতে হবে, কৌশলী হতে হবে, যেন কিছুতেই সেই চোরাবালিতে মেয়েরা হারিয়ে যেতে না পারে।
সব লিঙ্গের মানুষ যেমন পাশাপাশি বসবাস করবে, কাজ করবে, ঠিক সেইভাবেই নারীকে চিনে নিতে হবে পুরুষতন্ত্রের আলিগলি। তাই সতর্কতাও জরুরি। ঠিক সেভাবে পুরুষেরাও এগিয়ে আসুন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার সবচেয়ে বড় সন্ত্রাস ধর্ষণের বিরুদ্ধে পুরুষদের সবচেয়ে বড় ভূমিকাও একেবারেই কাঙ্ক্ষিত।