
বাংলাদেশের লোকগানকে বিশ্বের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন সোহিনী আলম। তিনি গান করছেন ‘ক্ষ’ আর ‘লক্ষী টেরা’র সঙ্গে। দুটোই লন্ডনভিত্তিক গানের দল। দুটি ব্যান্ডেই সোহিনী কণ্ঠশিল্পী। তাঁদের কনসার্টের দর্শক কি শুধুই বাংলা ভাষাভাষী? ‘মোটেই না।’ বললেন সোহিনী। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলা ভাষাভাষী দর্শক তো আসেনই, পাশাপাশি আরও থাকেন যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা ভাষার মানুষ। গানের শুরুতে কিংবা মাঝে গানের কথাগুলো ইংরেজি ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সব সময় তার প্রয়োজনও হয় না, কারণ সবাই সুরটা খুব পছন্দ করেন।’
ক্ষ ব্যান্ড বাংলাদেশে খুব পরিচিত হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন ইউটিউবে ক্ষ-র গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের মিউজিক ভিডিও দেওয়া হয়। আলোচনা আর সমালোচনা দুটোরই মুখোমুখি হতে হয় তাদের। সোহিনী বললেন, ‘আমরা গানটি গান হিসেবেই গাওয়ার চেষ্টা করেছি।’
সোহিনী আলম এখন আছেন উত্তর লন্ডনে। প্রতিবছর একবার অন্তত ঢাকায় আসেন। জানালেন, তাঁরা যেসব গান নিয়ে কাজ করেন, ওই সব গানের গীতিকার আর সুরকারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি নেন। যখন দেশে আসেন, তখন এই কাজটি করেন তিনি।
সোহিনীর জন্ম লন্ডনে। মা হিরণ আলম ছিলেন সংগীতশিল্পী, ডাকসুর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বিয়ের পর চলে যান যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। সেখানেও অব্যাহত ছিল তাঁর সংগীতচর্চা। গানে সোহিনীর হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। গান শিখেছেন খালাদের কাছেও। মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৮৭ সালে ঢাকায় চলে আসেন সোহিনী। ‘ও’ লেভেল আর ‘এ’ লেভেল করেছেন ঢাকায়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর যুক্তরাষ্ট্রে। কিছুদিন সেখানে চাকরিও করেছেন। এরপর চলে যান ইংল্যান্ডে, স্থায়ী হন লন্ডন শহরে।
লক্ষী টেরা কিষণ খানের ব্যান্ড। কিষণ খান পিয়ানোবাদক। ব্যান্ডটি অ্যাফ্রো, লাতিন, জ্যাজ এমনকি বাংলা ফোক গান নিয়েও কাজ করছে। লক্ষী টেরা প্রথম কনসার্ট করে ২০০৬ সালে লন্ডনের কুইন এলিজাবেথ হলে। কনসার্টে গান করেন অর্ণব। এই কনসার্টেই লক্ষী টেরার সঙ্গে পরিচয় সোহিনীর। সেই থেকে তিনি গান করছেন লক্ষী টেরার সঙ্গে। লক্ষী টেরা ঢাকায়ও এসেছে পাঁচবার। প্রথম আসে ২০০৯ সালে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা ওয়ার্ল্ড মিউজিক ফেস্টিভ্যালে লক্ষী টেরার গান দারুণ প্রশংসিত হয়।
ক্ষ-র যাত্রা শুরু ২০০৭ সালে। দুই বন্ধু অলিভার উইকস আর সোহিনী মিলে গড়ে তোলেন ব্যান্ডটি। সব ধরনের বাংলা গানই ক্ষ-র পছন্দ। ওই গানগুলোর কথা আর সুর ঠিক রেখে সংগীতায়োজনে ব্যবহার করা হয় আধুনিক বাদ্যযন্ত্র। সোহিনীর ভাষায়, ‘গানগুলোকে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরছি। আর তাই সংগীতায়োজনটা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
২০১২ সালে লন্ডনে যাত্রা শুরু করে কমলা কালেক্টিভ। লিসা গাজী, ফিলিয ওযজান, ক্যাটলিন অ্যাবোট আর সোহিনী আলম মিলে গড়ে তোলেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি। সোহিনীর ভাষায়, ‘আমরা নারীভিত্তিক গল্পগুলো বলার জন্যই প্রতিষ্ঠানটি গড়েছি।’
কমলা কালেক্টিভের প্রথম প্রযোজনা বীরাঙ্গনা: দ্য উইমেন অব ওয়ার। নাটকটি লিখেছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা ও লিসা গাজী। বাংলায় অনুবাদ করেন লিসা গাজী। লেখার পাশাপাশি নাটকে অভিনয়ও করেন লিসা। সঙ্গে আছেন অমিত রহমান। নির্দেশনা দিয়েছেন ফিলিয ওযজান। পর্দার পেছন থেকে গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সোহিনী আলম।
ছোট্ট এক গ্রামে মরিয়মের বাস। পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়ে প্রতি রাতেই পরিবার নিয়ে সে লুকিয়ে থাকে বাড়ির পেছনে পুকুরে। কিন্তু একদিন তাঁর জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। এভাবেই বীরাঙ্গনা মরিয়মের গল্পের মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে দেশের অসংখ্য বীরাঙ্গনার কথা। ছবি, গান আর সংলাপ দিয়ে কমলা কালেক্টিভ সাজিয়েছে বীরাঙ্গনা: দ্য উইমেন অব ওয়ার। গত বছর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলা ভাষায় নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় জাদুঘরে, পরদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একােডমীতে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। এরপর মঞ্চস্থ হয় চট্টগ্রামে থিয়েটার ইনস্টিটিউটে এবং সিরাজগঞ্জে শহীদ মনসুর আলী হলে। ইউরোপের বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটকটি।
সোহিনী জানান, কমলা কালেক্টিভ প্রতিষ্ঠার পর লিসা গাজী আসেন বাংলাদেশে। সিরাজগঞ্জে পাঁচজন বীরাঙ্গনার সঙ্গে তিনি অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এবার এই বীরাঙ্গনাদের নিয়ে তৈরি হবে তথ্যচিত্র। নাম রাইজিং সাইলেন্স। বীরাঙ্গনা: দ্য উইমেন অব ওয়ার নাটক তৈরির পেছনের গল্পও থাকবে তাতে।
বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও নির্দেশক আকরাম খানের সঙ্গে কাজ করছেন সোহিনী আলম। তিনি আকরাম খানের সর্বশেষ প্রযোজনা দেশ-এ অংশ নিয়েছেন। তবে এতে তাঁর কণ্ঠটি আগেই ধারণ করা হয়। আকরাম খানের নতুন প্রযোজনাতেও থাকছেন সোহিনী। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে তিনি আকরাম খানের নতুন এই প্রযোজনার সঙ্গে সফর করবেন। কারণ এবার আর তাঁর কণ্ঠ আগে ধারণ করা হবে না।
ক্ষ-র একমাত্র অ্যালবাম ক্ষ বেরিয়েছে গত বছর আগস্ট মাসে। আর্ক থেকে অ্যালবামের ডিজিটাল রিলিজ হচ্ছে এ মাসের শেষ দিকে। আর অডিও অ্যালবাম আকারে আসবে আগস্ট মাসে।
এ বছরই শিকড় বাংলাদেশের সঙ্গে লন্ডনে গান করবে লক্ষী টেরা। শিকড় বাংলাদেশের সদস্যরা হলেন নজরুল ইসলাম, বেবি আখতার এবং রব ফকির। সোহিনী বলেন, ‘শিকড় বাংলাদেশ আর আমরা একসঙ্গে লন্ডনে সং লাইনস উৎসব ও বিশ্ব সংগীত উৎসবে (ডব্লিউওএমএডি) গান করব।’
সোহিনী এখন দারুণ ব্যস্ত। কিছু সময় মুঠোফোনে আর কিছুটা ই-মেইলের মাধ্যমে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। সবশেষে জানালেন, তাঁর এই ব্যস্ততা এখন বাড়তেই থাকবে। কারণ তিনি গান নিয়ে নানা কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।