প্রেমে কি জবরদস্তি চলে

রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ছাত্রী রুবাইয়া। নীলফামারী সদরে বাড়ি তার। সেদিন রুবাইয়া গিয়েছিল বাড়ির পাশেই জলঢাকায় কোচিং করতে। ফেরার পথে তাকে জোর করে মোটরসাইকেলে তুলে নেন ফয়সাল আর রেজভি নামের দুই যুবক। পরের ঘটনা খুবই করুণ। চার কিলোমিটার দূরে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায় রুবাইয়া। আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান ফয়সাল ও তাঁর সঙ্গীরা। পরে অবস্থা খারাপ হলে রুবাইয়াকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। নিজের নাম গোপন করে রিমু নামের রুবাইয়াকে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করান ফয়সাল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সেই হাসপাতালে মারা যায় রুবাইয়া। আর হাসপাতালে রুবাইয়ার লাশ ফেলে পালিয়ে যান ফয়সাল। পত্রিকায় শিরোনাম হয় ‘রংপুর মেডিকেলে ছাত্রীর লাশ রেখে পালালেন তরুণ’।

রুবাইয়ার বাবা বলছেন, তাঁর মেয়েকে জোর করে অপহরণ করা হয়েছিল। ফয়সালের সঙ্গে রুবাইয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল না। হতে পারে সেটাই সত্যি।

তবে প্রশ্ন জাগে, ফয়সাল কেন রুবাইয়াকে এভাবে অপহরণ করতে গেলেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণে রুবাইয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। তরুণ বয়সীদের জন্য যা খুবই সম্ভব এবং স্বাভাবিক। হয়তো রুবাইয়া ফয়সালের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। ফলে ফয়সাল তাঁর প্রেমাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে বেছে নিলেন জোরজবরদস্তির পথ। বল প্রয়োগ করে রুবাইয়াকে নিজের মোটরসাইকেলে তুললেন। কে জানে হয়তো ফয়সালের হাত থেকে বাঁচতে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে নামতে চেয়েছিল রুবাইয়া। আর পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহতও হয়েছিল। আহত রুবাইয়াকে হাসপাতালে নিয়েও গিয়েছিলেন ফয়সাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত রুবাইয়াকে ফেলে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেলেন তিনি।

ফয়সাল বোঝেননি, প্রেম মানে কাউকে জোর করে দখল করা নয়, প্রেম একটি পারস্পরিক ভালো লাগার বিষয়। পারস্পরিক সম্মতি ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে প্রেম দিনে দিনে বিকশিত হয়, পরিণত হয়। যখন দুজনের সম্পর্কে জোরাজুরি, জবরদস্তি বা বল প্রয়োগ করা হয়, তখন সেটা আর প্রেম থাকে না, সেটা হয়ে যায় প্রভুত্ব। জবরদস্তির সঙ্গে প্রেম বা ভালোবাসার সম্পর্ক নেই। প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দ–অপছন্দ থাকতে পারে। প্রকৃত প্রেম সেই পছন্দকে সম্মান দেয়। অন্যকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনার চেষ্টা করা মানে তাকে দাসত্ব করতে বাধ্য করা। গুণীজনেরা বলেন, প্রেম মানুষকে মুক্তি দেয়, এটি কাউকে নতুন করে শিকল পরায় না। প্রেম আপনাকে একটি অদৃশ্য ডানা দেয় এবং যতটা সম্ভব উঁচুতে উড়তে আপনাকে সাহায্য করে। প্রকৃত প্রেম সেটাই, যা আপনাকে অনুভব করতে দেয় পূর্ণ স্বাধীনতা, যাতে আপনি নিজেই নিজের মতো হয়ে উঠতে পারেন।

ধরে নিই, রুবাইয়ার প্রতি ফয়সালের একধরনের আকর্ষণ ছিল, হয়তো সেই আকর্ষণ থেকেই সে তাকে আপন করে পেতে চেয়েছেন। কিন্তু চাওয়ার প্রক্রিয়াটি মোটেও সঠিক ছিল না, মেয়েটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে জোরজবরদস্তি করে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার যে পথ ফয়সাল অবলম্বন করেছেন, দিন শেষে তা ডেকে এনেছে এক করুণ ও মর্মান্তিক পরিণতি। এই যে নারীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ছলে-বলে-কৌশলে দখল করার প্রচেষ্টা, তা কখনোই প্রেম হতে পারে না। আসলে প্রেম করতে কাউকে বাধ্য করা যায় না। ওই যে গানের কথার মতোই, ‘প্রেম যেন এক চঞ্চল প্রজাপতি, চোখে এসে বসে। কেউ তারে অনায়াসেই পেয়ে যায়, কেউ চেয়েও পায় না।’

প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলেই নারীর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সহিংস আচরণ করা, তাকে হুমকি দেওয়া, অপহরণ করা, বাজে কথা বলা, উত্ত্যক্ত করা, সাইবার বুলিং করা—আমাদের সমাজে একশ্রেণির তরুণের প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সচেতনভাবে আমাদের এই ধরনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যিনি নারীকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন এবং নারীর মতামতকে শ্রদ্ধা করেন, তিনি প্রত্যাখ্যাত হলেও কখনোই এ রকম আচরণ করতে পারেন না।

নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করলে, তাকে ভোগ্যপণ্য বা সেবাদাসী না ভেবে পথচলার সম–অধিকারসম্পন্ন সঙ্গী হিসেবে ভাবতে পারলে নারীর প্রতি নেতিবাচক আচরণ অনেকটাই বদলে যেতে পারে।