পড়ায় ভালো, সহশিক্ষা কার্যক্রমেও
>স্কুল-কলেজে অনেকে নাচ-গান-বিতর্ক কিংবা খেলাধুলায় যুক্ত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে ভাবেন, এসব নাহয় থাক, এবার পড়ালেখায় মন দিই। হারমোনিয়ামটা অযত্নে পড়ে থাকে, ধুলো জমে ছোটবেলায় পাওয়া পুরস্কারগুলোর ওপর...। কিন্তু সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থাকলে যে আখেরে ক্ষতি নেই, বরং লাভ আছে, সে কথাই বললেন তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন মেধাবী শিক্ষার্থী

সহশিক্ষা কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা রঙিন করেছে
জান্নাতুল রাফিয়া
স্নাতকোত্তর, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমার বাড়ি চাঁদপুরে। স্কুল-কলেজে বিতর্ক করতাম। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, হলে উঠলাম, বিতর্কের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন মা-বাবাই জোর দিয়ে বললেন, ‘বিতর্কটা ছেড়ো না।’ পড়ালেখায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে, বাসা থেকে এমন চাপ কখনোই ছিল না। তবু আল্লাহর রহমতে ৩.৯৭ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক শেষ করেছি। বিভাগে আমার অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়মিত বিতর্ক করেছি। টেলিভিশন বিতর্ক, টিআইবি আয়োজিত জাতীয় বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এ ছাড়া ব্লাড ডোনেশন ক্লাবে কাজ করেছি, বিএনসিসিতে (বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্স সোসাইটির সঙ্গে বিভিন্ন পাঠচক্র, সেমিনারে অংশ নিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদপুর জেলার শিক্ষার্থীদের একটা সংগঠন আছে, নাম ডাকাতিয়া। এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ করি। আমার মনে হয়, ক্লাসরুমের বাইরে সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা রঙিন করেছে।
মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে পড়ে সময় বের করা কঠিন। আটটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস, তার মধ্যে ল্যাবে কাজ করতে হয়। ক্লাস মিস হলে বন্ধু বা শিক্ষকদের সহায়তায় সেটা বুঝে নেওয়া যায়, ল্যাব মিস হলে সেটা আর পাওয়া যায় না। কখনো কখনো এত কিছু ‘ম্যানেজ’ করতে কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সেটা গায়ে মাখিনি। গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়েছি বলে কথায় আঞ্চলিকতার টান ছিল। বিতর্কের চর্চা চালু রেখেছি বলেই সুন্দর করে কথা বলা শিখেছি, নিজেকে উপস্থাপন করা শিখেছি। ভালো রেজাল্টের জন্য বিভাগ থেকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। আর পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত থাকার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি রোকেয়া স্বর্ণপদক।

সময় পাওয়া যায় না, এটা ঠিক না
দীপন দেবনাথ
চতুর্থ বর্ষ, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। ছবি আঁকা, খেলাধুলা, গান, আবৃত্তি-ক্যাডেট কলেজে সবই করতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও তাই এসব ধরে রাখতে সমস্যা হয়নি। বুয়েটের বাস্কেটবল দলে আছি। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় দুইবার হ্যামার থ্রোয়িং ইভেন্টে পুরস্কার পেয়েছি। এ ছাড়া সময় পেলেই ছবি আঁকি। বুয়েটের চিত্রশিল্পীদের সংগঠন চারকোলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমি। এ বছর ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ‘বিশ্বমিল’-এ অংশ নিয়েছিলাম। ছবি এঁকে চারটা পুরস্কার পেয়েছি।
ছোটবেলা থেকে মা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতাগুলোতে নিয়ে যেতেন। এখনো মা-বাবা দুজনই খুব উৎসাহ দেন। তা ছাড়া আমার ফলাফল তো কখনো তেমন খারাপ হয়নি, তাই আমার ওপর তাঁদের আস্থা ছিল। বিভাগে আমার অবস্থান পঞ্চম। প্রথম বর্ষে রেজাল্ট একটু খারাপ হয়েছিল, নাহলে এখন হয়তো আরও ভালো অবস্থানে থাকতাম।
অনেকে বলে পড়ালেখার চাপে আর কিছু করার সময় পাওয়া যায় না। আসলে ইচ্ছে থাকলেই হয়। প্রথম বর্ষে পড়ার সময় আমারও এমন মনে হতো। ছুটির দিনেও হলে বসে কাজ করতাম, বাড়ি যেতাম না। সিনিয়র ভাইয়েরা প্র্যাকটিসের জন্য ডাকলে বলতাম, ‘ভাইয়া, এখন খেলতে গেলে আমি সময়মতো প্রজেক্ট জমা দিতে পারব না।’ ভাইয়ারা বলত, ‘এক ঘণ্টা খেললে কিছু হবে না।’ পরে দেখলাম, সত্যিই কিছু হয় না। বরং খেলাধুলা করলে শরীর-মন ভালো থাকে, পড়ায় মন বসে। বুয়েটের পরিবেশেরও একটা প্রভাব আছে। এখানে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই ক্রিকেট-ফুটবল খেলছে। কোনো প্রতিযোগিতার জন্য না, স্রেফ আনন্দের জন্য। বিনোদন না থাকলে পড়ায় মন বসবে কী করে?

কীভাবে গুছিয়ে নিতে হয়, শিখেছি মায়ের কাছে
প্রীথুলা প্রসূন
তৃতীয় বর্ষ, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সপ্তাহের সাতটা দিনের জন্য আমি রুটিন সাজিয়ে নিয়েছি। বিকেল পর্যন্ত ক্লাস। তারপর লাইব্রেরিতে পড়ালেখা। সন্ধ্যা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত থিয়েটারের মহড়া, হলে ফিরে বিকেলে যা পড়া হলো সেগুলো একবার রিভিশন দেওয়া, পরদিন ক্লাস থাকলে ভোরে উঠে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া, সঙ্গে প্রতি শুক্রবার ছায়ানটে নজরুলসংগীতের ক্লাস। এত কিছুর মধ্যেও কখনো ক্লান্ত লাগে না। কারণ দর্শন, থিয়েটার, গান-সবই আমার প্রিয়। পাঠাগারে বসে দর্শনের বই ওলটাতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে গানের ক্লাস। আর থিয়েটার তো আমার আরেক পরিবার।
আমি কখনো ক্লাস মিস করি না। সে জন্যই বোধ হয় প্রথম আর দ্বিতীয় বর্ষে বিভাগের প্রথম অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি। আমার মনে হয়, গান-নাটকের সঙ্গে আছি বলেই পড়ালেখা দ্রুত মাথায় ঢোকে। সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে মস্তিষ্কটা সব সময় সচল থাকে। যেহেতু দর্শন নিয়ে পড়ছি, যখন লালন-রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা হয়, ক্লাসের অন্যদের চেয়ে আমি বিষয়গুলো দ্রুত ধরতে পারি। আমার বিশ্বাস, গানের রেওয়াজ যেমন একটা পড়ালেখা, তেমনি মঞ্চে দাঁড়ানোর আগে স্ক্রিপ্ট পড়ে চরিত্রটা ধারণ করাও একটা পড়ালেখা। যে সময়গুলো আমরা ফেসবুকিং করে নষ্ট করি, সেই সময়ে ভালো লাগার কাজগুলো করতে পারলে মন ভালো থাকে।
মা-বাবা রাজবাড়ির বালিয়াকান্দিতে থাকেন। অনুপ্রেরণা দেন। এত কিছু একসঙ্গে করার কৌশল মায়ের কাছেই শিখেছি। মা একটা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাঁর সন্ধ্যা হয়ে যায়, তারপর আবার বাড়ির সমস্ত কাজ। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, মা কীভাবে যেন সবই গুছিয়ে নেন। তাঁর পরিশ্রমের কাছে আমার পরিশ্রম তো কিছুই না!