ফারুকের পুরোনো গাড়ির রাজ্য

মাহমুদুল ফারুক পুরোনো গাড়ির সংগ্রাহক। প্রায় ৪০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি ৬০টি পুরোনো গাড়ি সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সংগ্রহের প্রতিটি গাড়ির পেছনে রয়েছে একেকটি ইতিহাস; যা অনেক রোমাঞ্চকর গল্পকেও হার মানায়। এর মধ্যে কোনো গাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে জমিদার পরিবারের স্মৃতি, কোনোটা ব্যবহৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়, একটি গাড়িতে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তিনজন রাষ্ট্রপতি, আছে সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের গাড়িও। গাড়িপ্রেমী মাহমুদুল ফারুকের সংগ্রহের কথা রইল এই আয়োজনে।


সত্যি কি ঢাকার ভেতরে আছি! সুনসান পথে যেতে যেতে এই ভেবে ভ্রম হচ্ছিল। পথের দুই পাশজুড়ে বৃক্ষরাজি আর পাখির ডাকাডাকি শুনে আচমকা যেন উবে গেল খানিক আগে পোহানো যানজটের ধকল। রাজধানীর আবদুল্লাহপুর ব্রিজের ঠিক আগে ডান দিকে পথ ধরে এগোলেই রাজধানীর উত্তরখানের মৈনারটেক। এখানেই মাহমুদুল ফারুকের গাড়ির গ্যারেজ।
আমরা ওই পথে গিয়েছিলাম ১৫ সেপ্টেম্বর। তখন ভরদুপুর। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করতেই একজন বললেন, ‘ও, ফারুক সাহেবের গাড়ির গ্যারেজ! সোজা গিয়ে বাঁয়ে যান!’ তাঁর দেখানো পথ ধরে এগোতেই পাওয়া গেল বাড়িটি। এটি মাহমুদুল হকের খামারবাড়ি। যার বড় একটা জায়গাজুড়ে রয়েছে গাড়ির গ্যারেজ। আছে সবুজ ঘাসের গা ছুঁয়ে পিচঢালা সরু রাস্তা। তবে সে গ্যারেজে ঢুকতে পেরোতে হলো আরও একটি ফটক। আর ভেতরে ঢুকতেই তো চক্ষু চড়কগাছ!
গাড়ির রাজ্যে স্বাগত

এ যেন গাড়ির রাজ্য। যত্রতত্র পড়ে আছে গাড়ির যন্ত্রাংশ, গাড়ির খোলস। দুই কদম এগোতেই ছাউনির নিচের দেখা মিলল জলপাই রঙের এক গাড়ির। তারপর সারি ধরে রাখা বিভিন্ন মডেলের গাড়ি। এই গাড়িগুলো আর পথে দেখা যায় না। কোনোটা দেখতে ঝকঝকে, তকতকে, কোনোটার অবস্থা বেশ মুমূর্ষু! যার মধ্যে কয়েকটি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে; তা বোঝা গেল, কয়েকটার পাটাতনে কাঠ বিছানো দেখে। আরও দুই কদম এগিয়ে গিয়েই পরিচয় হলো আলী হোসেনের সঙ্গে; তিনি একজন মোটর মেকানিক। শেভ্রোলেট ১৯৫০ মডেলের গাড়িটি মেরামত করছিলেন (পরে জেনেছি এ গাড়িটি গাজীপুরের বলিয়াদি জমিদার পরিবারের)। ছোট বাক্যে বললেন, ‘গাড়িটা বইসা গেছে; পুরানা গাড়ি তো, কখন কী হয় বলা যায় না!’ আলী হোসেন ছোটবেলা থেকেই গাড়ি মেরামতের কাজ করেন। মাহমুদুল ফারুকের সঙ্গে আছেন তাঁর সংগ্রহের শুরু থেকে।

এর মধ্যেই ডাক এল পাশের দোচালা ঘরটা থেকে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মাহমুদুল ফারুক। সেই ঘরের মেঝেজুড়ে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের স্তূপ। মাহমুদুল ফারুক দীর্ঘদিন স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তবে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে দেশে। এই গাড়িগুলোর জন্যই আসা হয়। এবার দেশে এসেছেন দিন কয়েক আগে। সুঠামদেহী মাহমুদুল ফারুকের সঙ্গে যখন পরিচয়পর্ব এতটুকু এগোল, তখনই তিনি বললেন, ‘পুরোটা আগে ঘুরে দেখুন। পরে বিস্তারিত কথা বলি।’

তাঁর কথায়, ‘পুরোটা’ অর্থ বুঝলাম পাশের খামারবাড়ির একটি ঘরে ঢুকে। লম্বা ঘরটার দুই পাশজুড়ে সারি সারি গাড়ি। গত শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের গল্পের ওপর নির্মিত হলিউড চলচ্চিত্রে এই গাড়িগুলোর দেখা মেলে। শেভ্রোলেট, ফিয়াট, রোলস রয়েস, অস্টিন, মার্সিডিজ বেঞ্জ, জাগুয়ার, টয়োটা, ডিফেন্ডারসহ নামীদামি ব্র্যান্ডের পুরোনো মডেলের গাড়ি চোখে পড়ল। তাঁর সবচেয়ে পুরোনো গাড়িটি ১৯২৬ সালের। এখানে গাড়িগুলো বেশ যত্নে রাখা হয়েছে। বেরিয়ে আসার পথেই চোখ আটকাল কাপড়ে মোড়ানো একটি গাড়ির দিকে। লাল রঙের ফিয়াট গাড়িটি ১৯২৭ সালের। সেখানকার একজন তত্ত্বাবধায়ক বললেন, ‘গাড়িটি এখনো সচল।’ এই গাড়ির বাকি গল্প শোনালেন মাহমুদুল ফারুক নিজেই।
ফিয়াট ১৯২৭
কুমিল্লায় তাঁর এক বন্ধুর কাছে খবর পেয়েছিলেন ফিয়াট ১৯২৭ মডেলের গাড়িটির। খবর পেয়েই দে ছুট। কিন্তু গাড়ির দশা দেখে বেশ হতাশ হতে হয়েছিল তাঁকে। তারপর দরদাম চুকিয়ে ট্রাকে করে ঢাকায় এনেছিলেন সেটা। এরপর লেগে পড়েন পুনর্নির্মাণ করার কাজে। মাহমুদুল ফারুক বলেন, ‘অধিকাংশ গাড়ি বিকল অবস্থায় পেয়েছি। কিছু গাড়ি তো একদম পরিত্যক্ত ছিল। সে গাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে।’ বিকল ও একদম পরিত্যক্ত গাড়িগুলো আগের অবস্থায় নিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। বছরের পর বছর লেগেছে একটি গাড়ির হারানো রূপ দিতে। এ জন্য ঘাঁটতে হয়েছে প্রচুর বই, নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের গাড়ি-সম্পর্কিত প্রকাশনা।
সংগ্রাহকের সাতকাহন
মাহমুদুল ফারুকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তাঁর বাবা মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ পেশায় ছিলেন পুরকৌশলী (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার), চাকরি করেছেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণপূর্ত বিভাগে (পিডব্লিউডি)। মাহমুদুল ফারুকের গাড়ির প্রতি ঝোঁক তৈরি হয় খুব ছোটবেলায়। যার কিছুটা পেয়েছেন বাবার কাছে। মাহমুদুল ফারুক বলেন, ‘চার বছর বয়সে প্যাডেল কার চালাতাম। বাবার গাড়ি ছিল, ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়তাম।’

তবে শখের মাত্রা বেড়েছে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত যাওয়ার পর। দুষ্প্রাপ্য গাড়ি সংগ্রাহকদের ক্লাবের সক্রিয় সদস্যও ছিলেন সেখানে। মাহমুদুল ফারুক চট্টগ্রামের চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে লন্ডন চলে যান। ১৯৬২ সালে ভর্তি হন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেছেন। পড়াশোনা শেষে চাকরি করেছেন ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামে।

১৯৮২ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে চলে আসেন। কয়েক বছর দেশেই ছিলেন। তবে গাড়ি সংগ্রহের শখ সব সময়ই ছিল। কাজের ফাঁকে খোঁজ রাখতেন পুরোনো গাড়ির। যেখানেই কোনো খোঁজ পেতেন, ছুটে যেতেন। সংগ্রহ করতেন পুরোনো সব গাড়ি। প্রথম দিকে সংগৃহীত গাড়ি তাঁদের নয়াপল্টনের বাসার কাছেই রাখতেন। গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকলে, প্রায় ১৫ বছর আগে নিয়ে আসেন এই খামারবাড়িতে। জানালেন, এখন তাঁর গাড়ির সংখ্যা ৬০।
প্রথম গাড়ি সংগ্রহ
১৯৭৭ সালের কথা। কিছুদিনের জন্য দেশে এসেছেন মাহমুদুল ফারুক। তখনই খোঁজ পেলেন বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান ফোর্ড মোটরসের আকর্ষণীয় গাড়ি ফোর্ড মডেল এ (১৯২৭-৩১) গাড়ির। এই গাড়িগুলো চট্টগ্রাম অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনারা ব্যবহার করতেন। যুদ্ধ শেষে এই গাড়িগুলো স্থানীয় মানুষের হাতে চলে যায়। খবর পেয়ে মাহমুদুল ফারুক ছুটে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের নাজিরহাট উপজেলায়। গিয়ে দেখেন দুষ্প্রাপ্য গাড়িটি চাঁদের গাড়ি হিসেবে চালানো হচ্ছে। মাহমুদুল ফারুক বলেন, ‘তখনো গাড়িগুলোতে প্রায় ২০ জন যাত্রী নিয়ে চলাচল করত। সেখান থেকেই একটি গাড়ি সংগ্রহ করি।’

আরও যত সংগ্রহ
দুষ্প্রাপ্য নানা ধরনের জিনিস সংগ্রহের প্রতি তাঁর অপার আগ্রহ। গ্যারেজের এক কোনায় দেখা মিলল এমনই দুর্লভ কিছু বাইক। সংগ্রাহকের কাছে জানা গেল, এখানে বাইক আছে ২০টির মতো। এগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত বাইকও আছে। তবে যে বাইকটি নজর কাড়ল; এরকম বাইক দেখেছি বলিউডের লাগে রাহো মুন্না ভাই চলচ্চিত্রে। ইন্ডিয়ান চিফ নামের এই বাইকটি নাকি ১৯৪২ সালের। এ ছাড়া ত্রিশের দশকের একটি প্রশিক্ষণ বিমান, ব্রিটিশদের ব্যবহৃত নৌকা, স্পিডবোট ও একটা ট্রাক্টর দেখা গেল সংগ্রহে।

গাড়ি নম্বর ‘চট্টগ্রাম ক-২১৩৩’
এটি শেভ্রোলেট ১৯৫৬ স্টেশন ওয়াগন মডেলের একটি গাড়ি; বাংলাদেশে আনা হয় ১৯৫৬ সালে। গাড়িটি ব্যবহার করত চট্টগ্রাম বন বিভাগ। সে সময় চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ গাড়িতে চড়েছেন। চট্টগ্রামে তখন হাতে গোনা উন্নতমানের গাড়ি ছিল, যার একটি এই ‘চট্টগ্রাম ক-২১৩৩’ নম্বরের গাড়িটি। মাহমুদুল ফারুক শোনাচ্ছিলেন সেই গাড়ির ইতিহাস। তাঁর কাছে জানা গেল, ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন আইয়ুব খান, এই গাড়িতে ঘুরেছেন। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে চড়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মাহমুদুল ফারুক বললেন, ‘এই গাড়ি স্বাধীনতাযুদ্ধের অংশ। ১৯৭১ সালে গাড়িটি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল মুক্তিবাহিনী। এখনো গাড়ির জানালায় গুলির দাগ রয়েছে।’

‘সওগাত’ সম্পাদকের উপহার
ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে পুরোনো একটি ছবি বের করে বললেন, ‘গাড়ির পেছনে বসা এই মানুষকে চেনেন?’ তারপর নিজে থেকেই বললেন, ‘বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা সওগাত-এর সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শাহবাগের দিকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি।’ মাহমুদুল ফারুককে খুব স্নেহ করতেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। তাই হয়তো মৃত্যুর কয়েক বছর আগে নিজের ব্যবহৃত মরিস মাইনর ও ভক্সহল ভিক্টর গাড়ি দুটি মাহমুদুল ফারুককে উপহার দিয়ে যান। ওই গাড়ি দুটো দেখা গেল তাঁর গাড়ির রাজ্যেই।
গাড়ি সংগ্রাহকদের ক্লাব

পুরোনো ও দুষ্প্রাপ্য গাড়ি সংগ্রাহকদের সংগঠন—ওল্ড কার ক্লাব অব বাংলাদেশ (ওসিসিবি)। দেশের পুরোনো গাড়ি সংগ্রাহকদের এ ক্লাবটি ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরু করে। ক্লাবের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পুরোনো গাড়ি পরিচিত করাতেই আমাদের এই উদ্যোগ। ক্লাবের আয়োজনে দুষ্প্রাপ্য গাড়ি নিয়ে শোভাযাত্রা, প্রদর্শনীসহ গাড়ি নিয়ে নানা ধরনের আয়োজন করে থাকি আমরা।’

এই ক্লাব প্রথম পুরোনো গাড়ির শোভাযাত্রার আয়োজন করে ১৯৮৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, সেটা ছিল মোটরগাড়ির শত বছর পূর্তি উপলক্ষে। এরপর ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয় শোভাযাত্রার আয়োজন করে। দুই দিনের প্রদর্শনীটি হয়েছিল জাতীয় জাদুঘরে। সবশেষ ওসিসিবির পুনর্মিলনী উপলক্ষে ঢাকা ক্লাবে আয়োজন করা হয়েছিল আরেকটি প্রদর্শনীর। ক্লাবের মোট সদস্য এখন প্রায় ৩৫ জন। গাড়ি সংগ্রাহক মাহমুদুল ফারুক এই ওল্ড কার ক্লাব প্রতিষ্ঠাতাদেরই একজন।