ফুটবলেই ‘উন্নতি’

ফুটবলার উন্নতি খাতুন।
ছবি: প্রথম আলো

তিন বছর আগের কথা। যুব গেমসের ফুটবলে প্রথম জাতীয় পর্যায়ের কোনো আসরে খেলার সুযোগ পেয়েছেন উন্নতি খাতুন। সেই গেমসেই জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানীর নজর কাড়ল উন্নতির ক্রীড়া নৈপুণ্য। লেফট ব্যাক পজিশনে ওভারল্যাপিংয়ে খেললেন দুর্দান্ত। পুরো ৯০ মিনিট প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিলেন। তারপর তো ধারাবাহিক উন্নতি!

সেই ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাই শেষ হওয়া মেয়েদের লিগে খেলেছেন রানারআপ আতাউর রহমান ভূঁইয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। ২০১৮ সাল থেকে টানা জাতীয় বয়সভিত্তিক ফুটবল দলের আবাসিক ক্যাম্পে আছেন। গত বছর বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবলে ঢাকা বিভাগকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় খুলনা বিভাগ। আর খুলনাকে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় অবদান ছিল উন্নতির। প্রতিটি ম্যাচেই আলো ছড়িয়ে হয়েছেন টুর্নামেন্ট-সেরা ও সর্বোচ্চ গোলদাতা। ফাইনালে গোল করে সবার নজর কাড়েন আলাদাভাবে। টুর্নামেন্ট-সেরা ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে। তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমার নাম উন্নতি। ভবিষ্যতেও তুমি অনেক উন্নতি করবে, সেই দোয়া করি।’’ সে স্মৃতি উন্নতি খাতুন তাঁর মনের ভেতর যত্নে পোষেন।

ফুটবল পায়ে যিনি তরতর করে এগিয়ে চলছেন, সেই উন্নতির উঠে আসার গল্পটা সহজ নয়। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দোহারোতে উন্নতিদের বাড়ি। বাবা আবু দাউদ শৈলকুপা শহরে রিকশা চালান। মা হামিদা খাতুন অসুস্থ। সাত ভাইবোনের বিশাল সংসার। বাবার সামান্য আয়েই চলে পুরো সংসার। তাই সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে।

পরিবারের দারিদ্র্যের সঙ্গে উন্নতি খাতুন চারপাশের মানুষের মনের দারিদ্র্যও দেখেছেন। এলাকার অনেকের কথা হজম করতে হতো ফুটবল মাঠে নেমে। উন্নতি এমন এক এলাকা থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে মেয়েদের ফুটবল খেলাকে যেন ‘অপরাধের’ চোখে দেখা হয়। উন্নতি বলেন, ‘ফুটবল খেলি বলে এলাকার অনেকে নানা কথা বলত। প্রতিবেশীরা বলত, মেয়ে হয়ে হাফপ্যান্ট পরে কেন খেলি। অনুশীলনে গেলে অনেকে হাসাহাসি করত।’ তবে পাশে থাকতেন উন্নতির মা-বাবা। তাঁরা সমর্থন দিয়েছেন জন্যই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন বলে জানান উন্নতি। কাঠখড় পুড়িয়ে এ পর্যন্ত এসেছেন বলে ফুটবল ছাড়া কিছু বোঝেন না উন্নতি। তিনি বলেন, ‘ফুটবল খেলা আমার কাছে নেশার মতো মনে হয়। ফুটবল ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে পারি না।’

ছোটবেলায় দোহারো মডেল হাইস্কুলে দড়িলাফ খেলতেন। অ্যাথলেটিকসেও বরাবরই ভালো ছিলেন। স্কুলের শিক্ষক রবিউল ইসলাম উন্নতির দৌড় দেখে ফুটবল দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর উন্নতির বাঁ পায়ের শট এতটা জোরালো ছিল যে প্রথম অনুশীলনেই শিক্ষকদের মুগ্ধ করেন। এরপর ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় দোহারো স্কুল। ওই টুর্নামেন্টে উন্নতি হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়। এরপর জেএফএ কাপ ও বাংলাদেশ গেমসে অংশ নেন ফুটবলে। প্রতিটি টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকভাবে ভালো করেই জাতীয় নারী দলের কোচ গোলাম রব্বানীর নজরে পড়েন। এরপর বাফুফের আবাসিক ক্যাম্পে অনুশীলনের সুযোগ মেলে।

২০১৮ সালে বিকেএসপিতে ফুটবলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। পড়ছেন খেলোয়াড় গড়ার এই প্রতিষ্ঠানে। এরই মধ্যে খেলেছেন দিল্লিতে সুব্রত কাপে। খেলেছেন ২০১৯ সালের ভুটানে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে। জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী উন্নতিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। তিনি যেমনটি বলেন, ‘দিনকে দিন সে অনেক উন্নতি করেছে খেলায়। বয়সভিত্তিক দলে সে এখন গুরুত্বপূর্ণ এক খেলোয়াড়।’

করোনায় স্থগিত হয়ে গেছে অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ। লিগেও খেলতে গিয়ে চোট পাওয়ায় শেষ দিকে কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারেননি উন্নতি। তবে চিকিৎসক জানিয়েছেন চোট তত গুরুতর নয়। তাই ফুটবলার উন্নতির এখন অপেক্ষা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলা। উন্নতি বলেন, ‘আমার এখন একটাই স্বপ্ন, সাবিনা আপু, কৃষ্ণা আপুদের মতো জাতীয় দলে খেলার।’

সে লক্ষ্যেই নির্ভার অনুশীলন করছেন উন্নতি। তাঁর অনুশীলনে মনোযোগী হতে সহযোগিতা করেছে প্রধানমন্ত্রীর অনুদান। তাঁর পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কথা গত বছর পৌঁছেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পাঁচ লাখ টাকার অনুদান দিয়েছেন। আপাতত তাই মা-বাবার সাংসারিক টানাটানি নিয়ে ভাবছেন না তিনি। ভাবছেন না বলেই উন্নতির ভাবনাজুড়ে এখন শুধুই ফুটবল আর ফুটবল।