বন্ধু

মোহতেশাম ছোট্ট শিশু। বয়স আট কি নয়। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকে। এবার সে তার দাদার বাড়িতে ঈদ করবে। সামনে কোরবানির ঈদ। তাই এ উপলক্ষে সে ঈদের দুই দিন আগেই গ্রামের বাড়িতে চলে আসল। মেঘনার তীর ঘেঁষে তার দাদার বাড়ি। 

মোহতেশামের গ্রাম দেখতে খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ হলে যে চলে যায় দাদার কাছে। তখন আর যেতে ইচ্ছে করে না তার। শহরের মতো যানজট নেই এখানে। মুক্ত আবহাওয়ায় ছোটাছুটি করতে পারে। নেই কোনো বাধা। নদীতে সাঁতার কেটে গোসল করতে পারে। আরও কত্ত কী! তাইতো তার গ্রাম এত ভালো লাগে।
শনিবার দিন শ্রীঘর বাজার থেকে তার দাদা একটা কোরবানির গরু কিনে আনল। দাদা যখন বাজারে যায়, তখন মোহতেশাম তার সঙ্গে গিয়েছিল। সে গরুটি পছন্দ করেছে। কুচকুচে কালো ষাঁড়। নাদুস-নুদুস শরীর। গরু যখন বাড়িতে আনল তখন তার দাদাকে দিয়ে একটা ছবি তুলে রাখল।
ঈদের দিন সকাল বেলা চারদিকে হইচই পড়ে গেল। ছেলে-মেয়েদের কোলাহল। কেউ এ মুহূর্তে বিছানায় নেই। সবাই মেতে উঠল ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য। সবার মনে আজ শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মোহতেশাম তার দাদাকে সঙ্গে নিয়ে মেঘনা নদী থেকে গোসল সেরে আসল। মা সেমাই পাক করছে। বাবা-মা, দাদা সবাই একসঙ্গে মিলে সেমাই খেল।
মা পরিপাটি করে মোহতেশামকে কাপড় পড়িয়ে দিলেন। সুন্দর করে চিরুনি দিয়ে মাথা আচরিয়ে দিলেন। তারপর মোহতেশাম দাদার কাছে এসে বলল, দাদা!
দাদা বললেন, কী দাদা ভাই।
- চল আর দেরি কেন? ঈদগাহে যাই।
- হ্যাঁ, চল দাদা ভাই।
- তাড়াতাড়ি চল দাদা। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।
দাদা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ তাইতো!
মোহতেশাম নামাজের বিছানা হাতে নিল। দাদা-নাতি দুজনে ঈদগাহের দিকে রওনা হলো। নানা রঙের পোশাক পরে কচি কচি ছেলে-মেয়েরা ঈদগাহে যাচ্ছে। মোহতেশাম পড়েছে পাঞ্জাবি ও পায়জামা। দাদা-নাতি যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখন একটি গরিব ছেলে এসে মোহতেশামকে বলল, আমারে একটা ট্যাহা দ্যাও।
ছেলেটির পরনে একটা অর্ধ ময়লা শার্ট ও একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। মুখটা শুকনা। তাকে দেখে মোহতেশামের মায়া লেগে গেল। সে ছোট থেকেই গরিব-দুঃখীকে ভালোবাসে। গরিবের দুঃখ দেখলে তার চোখ দিয়ে জল এসে যায়।
মোহতেশাম ছেলেটিকে বলল, আচ্ছা তোমার নাম কী?
ছেলেটি বলল, আমার নাম রফিক।
- তোমার মা-বাবা নেই?
- ছেলেটির চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, আমার আব্বা নৌকা ডুইব্বা মইরা গেছে।
- আর তোমার মা?
- মা আমারে ছাইড়া আরেক বেডার লগে বিয়া বইয়া গেছে।
- এখন তোমার বাড়িতে আর কে আছে?
- আমার বুবু আছে। তার লগে আমি থাহি। বুবু হারাদিন ভিক্ষা কইরা যা আনে, তাই দিয়া আমডা চলি।
মোহতেশামের দাদা এসব দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখছেন।
মোহতেশাম ছেলেটির গায়ের ময়লা জামাটার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কি আর কোনো ভালো জামা নেই?
- না। ভালা জামা কত্তে আনমু। ঠিকমতো তো খাইতেই পারি না।
মোহতেশামের এ দৃশ্য দেখে দাদা ভাবছে, এতটুকু ছেলের গরিবের প্রতি কত দরদ!
মোহতেশাম তার বাবার কাছে এসে বলল, বাবা আমারতো অনেক জামা। একটা জামা ওই গরিব ছেলেটাকে দিয়ে দিই?
ছেলের মুখে এ কথা শুনে বাবাতো রীতিমতো অবাক! তারপর বলল, তুমি যদি দিতে চাও, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
মোহতেশাম ছেলেটিকে তার একটা শার্ট ও দশটা টাকা দেয়। ছেলেটি টাকা ও জামা পেয়ে খুশিতে বাহ্ বাহ্ করতে থাকে। সে তার দুই হাত দিয়ে দুঃখ ভরা অশ্রু মুছল। তারপর বলল, আল্লাহ তোমারে অনেক বড়লোক করুক। বলেই ছেলেটি যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আর অমনি মোহতেশাম বলল, এই শোন! তুমি দুপুরে আমাদের বাসায় খাবে।
- ঠিক আছে। বলেই ছেলেটি চলে গেল।
পরে দাদা-নাতি দুজনে ঈদগাহে রওনা হলো।
সারি বেঁধে মানুষ ঈদগাহে যাচ্ছে। রাস্তায় যেন আজ লোকজনের ঢল নেমেছে। ধীরে ধীরে ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হলো। দাদা-নাতি দুজনে পাশাপাশি নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষে যখন ইমাম সাহেব খুতবা পড়ছেন মোহতেশাম তা মনযোগ দিয়ে শুনছে। মোনাজাতের পর শুরু হলো কোলাকুলি পর্ব। সমবয়সী ছেলেরা পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করছে। মোহতেশামের ইচ্ছে করছে দাদার সঙ্গে কোলাকুলি করতে। কিন্তু ছোট বলে তার দাদার বুক নাগাল পাচ্ছে না। তাই সে লাফ দিয়ে তার দাদার কোলে উঠে কোলাকুলি করল। দাদাতো নাতির বুদ্ধি দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
এতিম ছেলেটিকে খুঁজে বের করল মোহতেশাম। এতিম ছেলেটিকে তাদের বাড়িতে নিয়ে এল। পেট ভরে খাওয়াল। তারপর তাকে বলল, আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।
এরপর থেকে যখনই মোহতেশাম গ্রামের বাড়িতে যেত, তখনই ছুটে যেত ওই এতিম ছেলেটির কাছে। হাত বাড়িয়ে দিত বন্ধুত্বের।