বন্ধুরা, ভালা থাইক্যো...

‘আমি মীনা বলছি’ অনুষ্ঠানে ফারজানা ইসলাম, আবরার সাজিদ, কামাল আহসান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ষ ছবি: বাংলাদেশ বেতারের সৌজন্যে
‘আমি মীনা বলছি’ অনুষ্ঠানে ফারজানা ইসলাম, আবরার সাজিদ, কামাল আহসান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ষ ছবি: বাংলাদেশ বেতারের সৌজন্যে

মীনা আপু, রেডিওতে তোমাদের অনুষ্ঠানটা শুনেই বন্ধুদের জানাই। তারাও এখন অনুষ্ঠানটি শুনতে আমার বাড়িতে আসে। প্রতি শুক্রবার আমি এই অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পোস্টারে বিভিন্ন টিপস লিখি। বেলা দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি হেঁটে মানুষকে বোঝাই। মীনা আপু, জানি না, এই চিঠি তোমরা হাতে পাবে কি না। কারণ, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে চিঠিটা বিলি করব।’

এই চিঠি মীনাকে লিখেছে সুনামগঞ্জের শোল্লাপাড়ার শাহিদুর রহমান। সারা দেশ থেকে প্রতি সপ্তাহে এ রকম অসংখ্য চিঠি আসে মীনার কাছে। সেগুলো থেকে বাছাই করে কিছু চিঠি মীনা পড়ে শোনায়। বলছিলাম, বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত ‘আমি মীনা বলছি’ অনুষ্ঠানটির কথা। প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিট থেকে ১১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।

মীনার সঙ্গে অবধারিতভাবেই থাকে তার ছোট্ট ভাই রাজু ও আদরের টিয়াপাখি মিঠু। প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠানের ২৫টি পর্ব প্রচারিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অংশগ্রহণও থাকে। আর থাকেন একজন বিশেষজ্ঞ। শ্রোতাদের কাছে যেটি আকর্ষণীয়, সেটি হচ্ছে কুইজ, চিঠির উত্তর ও ফোনো ইন।

প্রতি সপ্তাহে মীনা প্রচারিত অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি প্রশ্ন করে। আহ্বান থাকে সেই কুইজের উত্তর দেওয়ার।

ফোনো ইনে মীনা, রাজু, মিঠুর সঙ্গে শ্রোতারা সরাসরি কথা বলতে পারে। মীনা তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে।

‘আমি মীনা বলছি’র আকর্ষণীয় বিষয় শ্রোতাদের পাঠানো চিঠির উত্তর দেওয়া। অনুষ্ঠানটি কতটা জনপ্রিয়, সেটা বোঝা যায় চিঠিগুলো পড়ে।

এই যেমন একটি চিঠি এখানে উল্লেখ করতে পারি। চিঠিটি লিখেছেন শিকদার ইসাহাক আলী। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের শ্রোতা। ৩১ আগস্টের চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি মীনা বলছি ভীষণ ভালো লাগছে। জানতে পারছি বিচিত্র তথ্য। অনুষ্ঠান আকর্ষণীয় করতে আরও অনেক প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেন।’ তারপর তিনি চিঠিতে বেশ কটি পরামর্শ দিলেন।

অনুষ্ঠানটির প্রযোজনা সহকারী মনির হোসেন বলেন, ‘শিকদার ইসাহাক আলী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তিনি নিয়মিতই অন্যকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে সেটা পাঠান। শুধু তিনি একা নন, এ রকম আরও অনেক শ্রোতা আছে, যারা অনেক কষ্ট করে চিঠি পাঠায়। চিঠিগুলো পড়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়। যেমন কেউ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে চিঠি পোস্ট করে; কেউ অনুরোধ করে, চিঠিটি একটু পড়বেন, এক ঘণ্টার রাস্তা হেঁটে তারপর চিঠি ডাকে ছেড়েছি; কেউ হয়তো বলে, একটি চিঠি পাঠাতে ৪০ টাকা খরচ হয় যাতায়াতসহ, একটু পড়বেন চিঠিটা। এত আবেগপ্রবণ চিঠির ভিড়ে মাঝেমধ্যেই আমি আপ্লুত হয়ে পড়ি।’

তেমনই একটি চিঠি লিখেছেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের সাচায়নী গ্রামের শেখর আচার্য্য। তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা নিশ্চয় জানেন, আমি অসুস্থ মানুষ। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত লেখা পাঠাতে পারি না। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে ১০০ টাকা রিকশাভাড়া দিয়ে এসে চিঠি পাঠাতে আমার খুব কষ্ট হয়। তারপর চিঠিটা পড়া কষ্টটা মধুর হয়ে যায়।’

নরসিংদীর কাঁচিকাটা গ্রামের ইকবাল হোসেন লিখেছেন, ‘প্রিয় মীনা, মিঠু ও রাজু, তোমাদের জানাই সাদা মেঘ আকাশে উড়ে যাওয়া দেখার শুভেচ্ছা। আমি তোমাদের অনুষ্ঠান প্রথম পর্ব থেকে নিয়মিতভাবে শুনে আসছি। আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। মীনা এই অনুষ্ঠানে যৌতুকের কুফল নিয়ে একটি পর্ব প্রচার করার জন্য অনুরোধ করছি।’

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থেকে রকি ভাই বেতার শ্রোতা সংঘ থেকে ওমর ফারুক, নাজমুল, নাসরিন ও মারুফ লিখেছে, ‘সুফলা-সুজলা, শস্য-শ্যামলা পল্লির দূরদূরান্ত থেকে তোমাদের জানাই লাল গোলাপের শুভেচ্ছা। আমরা অনেক ছোট। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। রাজু, তুমি কোন শ্রেণীতে পড়ো? তুমি কি নিয়মিত স্কুলে যাও? মীনা আপু, তোমার মাধ্যমে বলতে চাই, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। যাঁরা এই মুহূর্তে শুনছেন, তাঁরা সকলে আপনার সন্তানদের স্কুলে পাঠান।’

নরসিংদীর বেলাব থেকে অনুসন্ধান বেতার শ্রোতা সংঘের আকতার হোসেন চিঠিতে পাঠিয়েছেন একটি কবিতা। ‘সবার জন্য শিক্ষা চাই, ধনী-গরিব ভেদাভেদ নাই/ শিক্ষা মোদের জ্ঞানের সাথী, অন্ধকারে জ্বালায় বাতি।...’

কারও কারও চিঠিতে অভিমানের ছোঁয়া পাওয়া যায়। নড়াইল লোহাগড়ার লাহুড়িয়া পশ্চিমপাড়া থেকে সাগরিকা আক্তারও তেমনই একটি চিঠি পাঠায়। ‘আমি তোমাদের অনুষ্ঠান নিয়মিত শুনি। আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি। আমি পঞ্চম পর্ব থেকে কুইজের সঠিক উত্তর লিখে পাঠাই। কিন্তু একটারও উত্তর পাচ্ছি না। তবে কি তোমরা আমাকে ভালোবাসো না?’

ঝিনাইদহের শৈলকুপার বাগুটিয়া থেকে তাজনীন নাহার লিখেছে, ‘গত অনুষ্ঠানে কথা হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে। কিছুদিন আগে আমাদের গ্রামে প্রচণ্ড ঝড়ের সময় বজ্রপাতে তিনটি শিশুর মৃত্যু হয়। এসো, সবাই তাদের জন্য দোয়া করি।’

এত এত চিঠি। অথচ তার সিকি ভাগই হয়তো পড়া হয় সময়স্বল্পতার জন্য। কিন্তু সব কটি চিঠির বার্তা অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, সবার হূদয় স্পর্শ করে। সে কথাই জানালেন মীনা চরিত্রে কণ্ঠদানকারী ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বয়সের মানুষ চিঠি পাঠান। কারও কারও বয়স সাত বা আট। আবার স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরাও আমার কাছে চিঠি পাঠান। সবাই নিজেদের মনের কথাগুলো বলার একটা প্ল্যাটফরম পেয়েছেন। এটা ভেবে খুব আনন্দ হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, গ্রামের মানুষগুলোর চাওয়া কত অল্প। তবে খারাপ লাগে, যখন সময়স্বল্পতার কারণে চিঠিগুলো পড়তে পারি না। তবে ভাবতে ভালো লাগে এই ভেবে যে শ্রোতারা অপেক্ষায় থাকেন মীনার কণ্ঠে “বন্ধুরা, ভালা থাইক্যো” শোনার জন্য।’অনুষ্ঠানে রাজুর চরিত্রে কণ্ঠ দিচ্ছে আবরার সাজিদ ও মিঠুর চরিত্রে কামাল আহসান।

কথা হলো বেতারের উপপরিচালক জুলফিকার রহমান কোরাইশীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘“আমি মীনা বলছি” অনুষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা কত বেশি, সেটি বোঝা যায় ফোনকল আর চিঠির পরিমাণ দেখে। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০০ চিঠি আসে। মীনা কার্টুন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এ দেশে এর জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। আর বাংলাদেশ বেতারের “আমি মীনা বলছি” একটি বড় ভূমিকা পালন করছে বলে ভালো লাগছে।’