বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের ধারা আশাব্যঞ্জক: কমলা ভাসিন

ভারতের প্রখ্যাত নারীবাদী লেখক, প্রশিক্ষক ও অধিকারকর্মী কমলা ভাসিন মারা গেছেন। গতকাল ২৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত তিনটার দিকে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের এক প্রশিক্ষণ কর্মলালায় যোগ দিতে ঢাকায় আসেন তিনি। সেই সময় তিনি সাক্ষাৎকার দেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে। ২৮ জানুয়ারি ২০০৯ সালে নারীমঞ্চে প্রকাশিত সেই লেখা এখানে আবারও প্রকাশ করা হলো

ভারতের প্রখ্যাত নারীবাদী লেখক, প্রশিক্ষক ও অধিকারকর্মী কমলা ভাসিন
ছবি: জান্নাতুল মাওয়া

সমাজ, সামাজিক লিঙ্গ ও নারী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী কমলা ভাসিন। জন্ম ১৯৪৬ সালে। বড় হয়েছেন ভারতের রাজস্থানে। জয়পুরের মহারানি কলেজে তিনি শেষ করেন বিএ। রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ সম্পন্ন করে পশ্চিম জার্মানিতে চলে যান উন্নয়ন সমাজবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার জন্য। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন জার্মানির একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাষক হিসেবে। কিন্তু এক বছর পর ভারতে ফিরে আসেন এবং ‘সেবা মন্দির’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) উন্নয়নবিষয়ক সচিব হিসেবে রাজস্থানের দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি যোগ দেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় (এফএও)। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময় একত্রে কাজ করেছেন জাতিসংঘ, বিভিন্ন দেশের সরকার, দ্বিপক্ষীয় সংস্থা, মিডিয়া, গবেষক, প্রতিষ্ঠান এবং অন্যদের সঙ্গে। বর্তমানে যুক্ত আছেন সাঙ্গাত, জাগোরি ও অঙ্কুরের সঙ্গে। কমলা ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৫-এর জন্য ১০০০ নারী’ প্রকল্পের দক্ষিণ এশিয়ার সক্রিয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত আছেন। উন্নয়ন, কর্মশালা, যোগাযোগ ও মিডিয়া, লিঙ্গ এবং নারীবাদী আন্দোলনবিষয়ক অনেক বই লিখেছেন তিনি, যা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মেয়েশিশুদের জন্য গান লিখেছেন, সুর করেছেন ও গেয়েছেন। ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ আয়োজন করে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার—আমাদের প্রতিদিনের জীবনে জেন্ডার। কর্মশালায় সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন কমলা ভাসিন। সেই ফাঁকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন নারীমঞ্চের প্রতিনিধি শিখ্তী সানী

  • কর্মজীবনের শুরুতে আপনি যাত্রা করেছিলেন পশ্চিম জার্মানিতে প্রভাষক হিসেবে। এক বছর পর আপনি ভারতে ফিরে এসে তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। কোন অনুপ্রেরণার জন্য আপনি এ পথ বেছে নিয়েছিলেন?

কমলা ভাসিন: আমার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমার ছেলেবেলা কেটেছে রাজস্থানে। আর ভারত সে সময় সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে—নানা আদর্শবাদ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জাতিগত বৈচিত্র্য—সবকিছু আমাকে আকর্ষণ করত। আমি জানতাম যে আমাকে ভারতেই ফিরে আসতে হবে। আর আমি চাই অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করতে, যারা দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। তাই প্রভাষক হওয়ার এক বছর পর আমি সেবা মন্দিরের সঙ্গে কাজ শুরু করি। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের উন্নয়নের জন্য, তাদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কাজ শুরু করি রাজস্থানে। সেখানে আমি অনুভব করেছি আদর্শগত পরিবর্তনগুলো। আমি শিখেছি আসল বাস্তবতা, যা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চতর শিক্ষাও শেখাতে পারেনি। সেখানে আমি শিখেছি দারিদ্র্য, শিখেছি পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের দ্বারা অনুগত সমাজব্যবস্থা, অবিচার ও অসমতা।

  • নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সিদ্ধান্ত কি সে সময়ই নেওয়া?

কমলা ভাসিন: আমি কাজ শুরু করেছিলাম দরিদ্র মানুষদের জন্য। ধীরে ধীরে আমি অনুভব করলাম, আমাদের নারীরা পুরুষদের চেয়েও অনেক দরিদ্র। যখন আমি শোষিত জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করছি, তখন অনুভব করলাম, নারীরা পুরুষদের চেয়েও অনেক শোষিত। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষিত হচ্ছে সমাজব্যবস্থা থেকে, ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে, পরিবার ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে। আর আমি শুধু নারীদের নিয়েই কাজ করিনি; আমি ২৯ বছর ধরে আছি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সঙ্গে। আমি আমার আন্দোলনের পথে সমতায়ন, ন্যায়বিচার, উন্নয়ন, দারিদ্র্য, লিঙ্গ ও নারীদের বিষয়গুলো এক করে নিয়েছি। আমি কাজ করছি নারীবাদী হিসেবে, সামাজিক ও উন্নয়নকর্মী হিসেবে।

  • নারীবাদী আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা কীভাবে দেখেন?

কমলা ভাসিন: শারীরিক পরিবর্তন ছাড়া মেয়ে ও ছেলেদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুধু যৌন ও পুনরুত্পাদনের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য আছে, বাকি সব অঙ্গ একই রকম। জৈবিক বা শারীরিক এ গঠনের জন্যই ছেলেরা পুরুষ লিঙ্গে অবস্থান করে আর মেয়েরা অবস্থান করে নারী লিঙ্গে। আর নারী ও পুরুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংজ্ঞাকে বলে সামাজিক লিঙ্গ। এই সামাজিক লিঙ্গীয় বৈষম্য প্রকৃতির তৈরি নয়। সমাজ তাকে বৈষম্যের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষে পরিণত করে। সমাজই বেঁধে দেয় মেয়েলি ও পুরুষালি বৈশিষ্ট্য। এতে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য বেড়ে যায়। মনে হয়, নারী ও পুরুষ একেবারে দুটি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। ধনী ও দরিদ্র, ব্রাহ্মণ ও শূদ্র, কালো ও সাদা এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে—সবই সমাজের তৈরি, প্রকৃতির নয়। এ বৈষম্যই তৈরি করে বিবাদ, বিসংবাদ, বিতর্ক ও সহিংসতা। সারা বিশ্বেই সামাজিক লিঙ্গীয় পার্থক্য হচ্ছে মূলত পিতৃতান্ত্রিক, যার গোড়ায় রয়েছে পুরুষ আধিপত্য। আর এ পার্থক্যগুলো আসলে নারীবিদ্বেষী। তাই মেয়েদের প্রতিবন্ধকতা, বৈষম্য ও নির্যাতন সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত।

যেহেতু সামাজিক লিঙ্গ আমাদের সবার তৈরি, সমাজের তৈরি; আমরা ছেলে ও মেয়ের, নারী ও পুরুষের একটি নতুন সংজ্ঞা দিতে পারি। তৈরি করতে পারি এমন এক সমাজ, যেখানে মেয়ে মানেই অসহায়, দুর্বল, শোষিত বা অত্যাচারিত নয়; তেমনি ছেলে মানেই কঠোর, উদ্ধত, আদেশকারী ও নির্যাতনকারী নয়।

২০০৯ সালে নারীমঞ্চে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকার
  • নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র কথাটি অনেকবার উচ্চারিত হয়। এটিই কি সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক নারীর অসমতা ও অধীনতার প্রধান কারণ?

কমলা ভাসিন: পিতৃতন্ত্র সাধারণভাবে বোঝায় পরিবারে পিতার শাসন। কিন্তু বর্তমানে অর্থটা বদলে গেছে, এটি একটি সামাজিক ব্যবস্থা বা কাঠামো এবং একটি আদর্শবাদ, যেখানে পুরুষদের শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। পুরুষেরা তাদের উত্তম দাবি করে সম্পদ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে, এমনকি আমাদের মনে আধিপত্য করার সুযোগ করে নিয়েছে। এটা সমাজের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সৃষ্টি; ঈশ্বরের দান নয়। নারী এখানে অসহায়, নির্যাতিত ও অধম। শুধু নারীরাই নয়, পুরুষেরাও এই পিতৃতন্ত্র কাঠামো এবং আদর্শবাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। পিতৃতন্ত্র সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক অসমতা, অন্যায় ও অধীনতার কারণ এবং নারীবাদ সর্বদা এই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে।

  • পিতৃতন্ত্রের বিপরীত কী হতে পারে? আর এর সমাধানই বা কী বলা যেতে পারে?

কমলা ভাসিন: পিতৃতন্ত্রের বিপরীত কিন্তু কখনো মাতৃতন্ত্র হতে পারে না। যদি পিতৃতন্ত্র একটা অসম ব্যবস্থা হয়, তাহলে মাতৃতন্ত্রও একই রকম একটি ব্যবস্থা। ঠিক যেমন ম্যালেরিয়ার মতো রোগের সমাধান নিউমোনিয়ার মতো আরেকটি রোগ হতে পারে না। ম্যালেরিয়া রোগের বিপরীত হতে পারে সুস্থ শরীর। তাই আমরা বলছি, পিতৃতন্ত্রের বিপরীত সমতায়ন। এখন সমতায়ন কি সম্ভব? অনেকে বলে, হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি সমতায়নও সম্ভব নয়। কিন্তু কনে আঙুলে ব্যথা পেলে কি আমরা বলি, ও তো আকারে ছোট, ওকে ফেলে দাও, ওর চিকিত্সার দরকার নেই। তা তো আমরা বলি না। কারণ, প্রতিটি আঙুল আমাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই সমান মূল্য দেওয়া দরকার। ঠিক তেমনি নারী ও পুরুষ উভয়ে আমাদের সমাজের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকেরই আলাদা মূল্য আছে। তাই আমাদেরও একইভাবে তাদের মূল্য, সম্মান ও অধিকার দিতে হবে। আমাদের আন্দোলন বা বিতর্ক এক বা অভিন্নতার জন্য নয়; অধিকার সমতায়নের জন্য।

আর নারীবাদই পিতৃতন্ত্রের সমাধান। নারীবাদ সমর্থন করে সমতা, সম্মান ও স্বাধীনতাকে। নারীবাদ মানে নারী আর পুরুষের প্রতিযোগিতা নয়। নারীবাদ সমতা ও অসমতার মধ্যকার যুদ্ধ, যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়েই দুই পক্ষে অবস্থান করছে। নারীবাদ একটি সচেতনতা। পিতৃতন্ত্রের অধীনে নারীর শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং সচেতন পদক্ষেপ নেওয়াই নারীবাদ। নারী কিংবা পুরুষ উভয়েই সজ্ঞানে কিংবা না জেনেই হতে পারেন একজন নারীবাদী আন্দোলনের সমর্থক।

  • নারীবাদকে ব্যক্তি ও সমাজ সব সময় অপছন্দ বা ভয়ের দৃষ্টিতে দেখে কেন?

কমলা ভাসিন: বেশির ভাগ মানুষ নারীবাদ সম্পর্কে জানে না; তাই অপছন্দ করে থাকে। আমরা তো শুধু নারীদের কথাই বলছি না! আর নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে পিতৃতন্ত্রকে। পিতৃতন্ত্র সমাজে পুরুষদের, এমনকি নারীদের মনে বদ্ধমূল বৈষম্যপূর্ণ নিয়ম তৈরি করে দিয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। তা ছাড়া নারীবাদ প্রশ্ন তুলেছে সবকিছু নিয়ে। নারীবাদ প্রশ্ন তুলছে ধর্ম নিয়ে, পড়াশোনার ব্যবস্থা নিয়ে; আইন, রাজনীতি, নিয়ম, ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ ও কনজিউমারিজম নিয়ে; প্রশ্ন তুলছে যুদ্ধ, পর্নোগ্রাফি, প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবহার নিয়ে, যেগুলো কোটি টাকার বাণিজ্যের উত্স। তাহলে কেন মানুষ নারীবাদ নিয়ে খুশি হবে। দেখো পিতৃতন্ত্রের সুযোগ-সুবিধা আর লাভগুলো, যখন পিতৃতন্ত্রকে আমরা আঘাত করছি, তাহলে কেন তারা আমাদের ভয় পাবে না?

  • প্রসঙ্গ বদলে আসি। আপনি নারীর ক্ষমতায়নকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সংসদীয় নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৩টিতে ১৯ জন নারী জয়লাভ করেছেন। পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনের সময় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী হিসেবে নারীদের ক্ষমতায়নকে আপনি কীভাবে দেখেন?

কমলা ভাসিন: সবকিছুর প্রথমে দেখতে হবে কেন আমরা নারীদের ক্ষমতা দিতে চাই? কারণ, পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র নারীদের ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। তাই আমাদের প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন; এবং কাদের আমরা ক্ষমতা দিতে চাই? নারীদের যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে পিতৃতন্ত্রের অধীন। ঠিক যেমন আমরা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়নে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই; কারণ বর্তমান শ্রেণীব্যবস্থা তাদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আমার কাছে নারীর ক্ষমতায়ন হলো ক্ষমতার অংশীদারিত্ব, ক্ষমতার ভাগাভাগি। এই নয় যে পুরুষদের কাছ থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নারীদের দিয়ে দিতে হবে। ক্ষমতায়ন হলো নারীকে তার শিক্ষা, পরিকল্পনা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পদ, বিয়ে, গতিময়তাসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব দেওয়া, যাতে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র উপকৃত হয়। আজ আমরা চাঁদে প্রযুক্তি নিয়ে পৌঁছে গেছি, অথচ মেয়েদের আজও কুয়া থেকে পানি মাথায় করে বয়ে আনতে হয়। কেন এমন হয়? কারণ, সিদ্ধান্তগুলো পুরুষরা একতরফাভাবে নিচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন সফল হলে অনেক গঠনমূলক সিদ্ধান্ত অর্জিত হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের এ ধারা আসলেই চমত্কার ও আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা নারী বলেই অবস্থার সম্পূর্ণ সফলতা আনতে পারবে। পুরুষেরা ১৯৭১ সাল থেকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বারবার ব্যর্থতা দেখিয়েছে। নারীদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ব্যর্থ হতে পারে। একজন নারী প্রধানমন্ত্রী মানেই তো এই নয় যে পরাশক্তির আধিপত্য, আগ্রাসন, শোষণ, দুর্নীতি—সব শেষ হয়ে যাবে। তখনই অবস্থার পরিবর্তন হবে, যখন একজন নারী প্রধানমন্ত্রী সত্ ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে যদি পরিবার বা দলকে দুর্নীতির জন্য প্রশ্রয় দিই, তাহলে কিছুই বদলাবে না। তাই নারী-পুরুষ যা-ই হোক না কেন, সেটি বিবেচ্য নয়! নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সততা, ক্ষমতার সঠিক অনুশীলন, একজন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীবাদীর দৃষ্টিকোণ যদি চর্চা করা হয়, তাহলেই বদলাবে দেশ।

আর বিভিন্ন মন্ত্রী পদে নারীদের স্থান এ জন্যই দেওয়া হয়েছে। কারণ, তাঁরা উপযুক্ত, দক্ষ, প্রতিশ্রুতিশীল এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। যদি পরিবারের বংশানুক্রমকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো, তাহলে নারী হলেও কিন্তু প্রাপ্তির তেমন কিছুই থাকত না। নারীদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি তাঁদের অবশ্যই দক্ষ হতে হবে।

  • বাংলাদেশ, ভারত কিংবা দক্ষিণ এশিয়া থেকে সারা বিশ্বে নারীদের অবস্থানকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

কমলা ভাসিন: আমি নারীদের সর্বদা একটি শ্রেণীতে রাখি। কারণ, বাংলাদেশের নারী বা ভারত কিংবা দক্ষিণ এশিয়াই বলো আর বিশ্বব্যাপী নারীদের অবস্থানের কথাই বলো, সারা বিশ্বে যে ব্যবস্থাটা চলছে তা হলো পিতৃতন্ত্র। ভারত-বাংলাদেশে কিংবা দক্ষিণ এশিয়ায় এরা খুব খারাপ অবস্থায় আছে শিক্ষার অভাব আর দারিদ্র্যের জন্য। কিন্তু প্রায় সবখানেই কমবেশি নারীরা একই শোষণ, নিপীড়ন বা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব, এখনো তারা একজন নারীকে প্রধানমন্ত্রী করতে পারেনি। সমস্যা শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নেই।

আর উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীর অবস্থান নির্ধারিত হয় সেখানকার সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা, আইন ও এর প্রয়োগ, নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরতা, নারীর রাষ্ট্র কিংবা গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ এবং গণতন্ত্রের মানের ভিত্তিতে। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে সংগ্রাম ছিল এবং থাকবে। সামাজিক লিঙ্গে সমতা আনতে পেরেছে এমন একটা দেশ বলা যেতে পারে স্ক্যান্ডিনেভিয়াকে। তারা নারীদের আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছে, সামাজিক আন্দোলন করেছে।

  • আপনি ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৫-এর জন্য ১০০০ নারী’ প্রকল্পে কাজ করেছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনার অনুভূতি জানাবেন আমাদের? এখানে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান নিয়ে কিছু বলুন।

কমলা ভাসিন: প্রকল্পটি নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে। আমরা বিশ্বাস করি, নারীরা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি অবদান রেখেছে। শান্তি মানে তো শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়; তাই নারীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য শান্তিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার লক্ষ্যে প্রায় ২০০ দেশ থেকে ১০০০ নারী নির্বাচন করে ২০০৫ সালে নোবেল পুরস্কার কমিটিকে দেওয়া হয়। কারণ, শান্তি এমন কোনো বস্তু নয় যে শুধু একজন তা আনতে পারে। তাই শুধু একজনকে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হবে? আর এই ১০০০ সংখ্যাটি একটি প্রতীকী শব্দ। লাখ লাখ নারীর অবদান, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের নিরলস প্রচেষ্টাকেই প্রতিনিধিত্ব করছে এই ১০০০ নারী। আমরা ২০০৫ সালে সেই শান্তি পুরস্কার অর্জন করতে পারিনি, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই ১০০০ নারীর কথা জানার জন্য ২১০০ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে, আটটি ছবি বানানো হয়েছে এবং আরও কাজ হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি নারী বেছে নেওয়া হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে ১৬ জন নারী বাংলাদেশের এবং আমরা আসলেই খুব গর্বিত তাঁদের পেয়ে। এই ১০০০ নারীর অনেকেই এসেছেন একদম তৃণমূল পর্যায় থেকে, যাঁদের অবদান অতুলনীয়। বাংলাদেশ থেকে আমরা পেয়েছি খুশী কবির, রোকেয়া কবীর, হেনা দাস, অ্যাঞ্জেলা গোমেজ, শিরিন বানু, রাফিজা বেগম, এবাদন বিবি, আশালতা বৈদ্য, নন্দা রানী দাস, সন্ধ্যা রায়সহ আরও অনেককে।

  • আপনি বিভিন্ন সময় নানা বিষয়ে গান লিখেছেন, গেয়েছেন। সংগীতের সঙ্গে এই একাত্ম বন্ধনের কারণ কী?

কমলা ভাসিন: নারীবাদী আন্দোলনে আমি দেখেছি, সংগীত খুব গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী বস্তু। একত্রে অনেকের মধ্যে সংগীত দ্রুত অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দিতে পারে। আর সংগীতের মধ্য দিয়ে অনেক গুরু কথা অনেক সহজে বলা হয়ে যায়, যা অন্তরে গিয়ে স্থান করে নেয়।

  • বিভিন্ন আন্দোলনের দীর্ঘ পথে নানা প্রতিবন্ধকতা কিংবা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কখনো? কিংবা কোনো সুখকর মুহূর্ত কিংবা প্রাপ্তি?

কমলা ভাসিন: খুব বেশি নয়। কিছু সমস্যা তো থাকেই। আর নতুন কিছু নিয়ে কাজ করতে গেলে অবশ্যই লোকের সমালোচনাই বলো আর কটূক্তিই বলো, শুনতে হয়। কিন্তু আমি একই সঙ্গে অনেক অনেক সমর্থন পেয়েছি। এই পথ আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গ দিয়েছে। বেঁচে থাকার মাধ্যম দিয়েছে। আমার ২৭ বছর বয়সী মেয়ে হঠাত্ মৃত্যুবরণ করে। ছেলেটা আমার ভীষণ অসুস্থ। আমার পারিবারিক জীবন অনেক বন্ধুর ছিল। আমার মেয়ের মৃত্যুর পর আমি এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন জীবন পেয়েছি। আমি মনে করি, আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে আমি এমন কাজ করছি, যা আমি করতে চেয়েছি এবং যার আদর্শবাদ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

  • আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

কমলা ভাসিন: তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।