বাড়িতেই হোক দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ

মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের চেতনা শুরু হোক পরিবার থেকে। মা দিল আফরোজের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুেদ্ধর ছবি আঁকছে অরিন ও জেরিন।
ছবি: খালেদ সরকার

ঢাকার বনশ্রীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই বোন অরিন ও জেরিন। প্রতিবছর বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলেই ওদের পরিবারে বাড়তি আনন্দ যোগ হয়। শুরু হয় নতুন নতুন আয়োজন। দুই বোন বছরব্যাপী মায়ের কাছে বিভিন্ন ধরনের গান শেখে। তবে ডিসেম্বরজুড়ে থাকে শুধুই দেশের গান, বিজয়ের গান। এই মাসে তাদের ছবি আঁকার বিষয়বস্তুও পাল্টে যায়। রংতুলি থাকে একাত্তরের বিজয়গাথাকে কেন্দ্র করে ছবি আঁকায় ব্যস্ত। বাড়ির বারান্দার গ্রিলে বেশ আয়োজন করে তারা ঝুলিয়ে দেয় লাল-সবুজের পতাকা। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা ইমরান উর রশিদ অফিস থেকে ফেরার সময় কিনে আনেন মাথায় জড়ানোর ব্যান্ডানা, কখনো–বা লাল-সবুজের ব্যাজ। আর এসব করতে করতেই তাঁর সন্তানদের নানা রকম প্রশ্ন জাগে দেশকে ঘিরে। সেসব প্রশ্নের হাসিমুখে জবাব দিয়ে চলেন ওদের স্কুলের শিক্ষক মা দিল আফরোজ আর বাবা ইমরান। সন্তানদের মধ্যে দেশের প্রতি আলাদা ভালোবাসা দেখে মা–বাবার মুখেও ফোটে হাসি।

কেমন কাটে বিজয় দিবসের দিন, জানতে চাইলাম এই দম্পতির কাছে। জানালেন, প্রতিবছর বিজয় দিবসে নিজেদের স্কুলে নানা রকম আয়োজন থাকে। মেয়েরা সেসব আয়োজনে অংশ নেয়। মাঝেমধ্যে পুরস্কারও যোগ হয় ওদের ঝুলিতে। স্কুলে সেদিন লাল-সবুজ পোশাক জড়ানো থাকে মা আর মেয়েদের পোশাকে। স্কুল থেকে ফেরার সময় মা আর মেয়েদের সঙ্গে যুক্ত হন বাবা। পুরো পরিবার কোনো বছর চলে যায় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে, কোনো বছর বিজয় দিবসের অন্য কোনো অনুষ্ঠানে।

বড় মেয়ে তো নিজেই একটা দেশের গান লিখে সুরও করেছে। আবার গেয়েছেও। মা–বাবা সেই গান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করার পর বেশ বাহবা পেয়েছেন বন্ধুদের কাছ থেকে। তা ছাড়া ওরা দুজনেই গান করে, ওদের মা কি-বোর্ড বাজান আর বাবা গিটার। পারিবারিক এমন পরিবেশে প্রায় প্রতিটি বিশেষ দিন আরও আনন্দময় হয়ে ওঠে এই পরিবারে।

সন্তানদের দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগানোর প্রথম কাজটা শুরু করা উচিত পরিবার থেকে। সেটাই মনে করেন দিল আফরোজ ও ইমরান দম্পতি। প্রতিবছর বিজয় দিবস উপলক্ষে দেশের সবখানে নানা রকম আয়োজন থাকে। বীর যোদ্ধাদের স্মরণ করা, একাত্তরের স্মৃতিচারণাসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এই দিন থাকে সরকারি ছুটি। ফলে অনেকেই পরিবার নিয়ে বাইরে ঘুরতে যান। সন্তানদের নিয়ে কুচকাওয়াজ বা র‌্যালিতে হাঁটেন কেউ কেউ। শিক্ষক দিল আফরোজ মনে করেন, শুধু এই একটি দিনের জন্য নয়। বাড়িতে সন্তানদের নিয়মিত খেলাচ্ছলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী চলে এসেছে। বিজয়ে এই ৫০ বছর পরও যেন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত থাকে, সেই ভাবনা তাদের মধ্যে জাগ্রত রাখতে পারে পারিবারিক শিক্ষা।

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এনামুল হক বলেন, ‘পরিবারের বড়রা ছোটদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে পারেন। ভালো কোনো বই কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র শিশুদের সঙ্গে নিয়ে দেখতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রও দেখাতে পারেন। ভিডিও চিত্র দেখলে শিশুদের মনে সেটার স্মৃতি স্থায়ীভাবে গেঁথে থাকে।’

করোনাভাইরাসের কারণে এবারের বিজয় দিবসের আয়োজনে হয়তো জনারণ্য হবে কম। কিন্তু ঘরে ঘরে যদি আয়োজনটা চলমান থাকে, তাহলে শিশুরাও বড় হবে একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হৃদয়ে নিয়ে।