
অনু, তুমি কি এখন ছবি আঁকছ? ছোট একটা ক্যানভাস, একটা ছোট নদী, তোমার নূপুরের মতো ছোট ছোট ছন্দে বয়ে যাচ্ছে, পাশে একটা চরের মতো, সাদা সাদা কাশফুলে ছেয়ে আছে? নদীর জলে পা ভিজিয়ে তুমি হাসছ। পাশে আমি। আমি এখন আর ভয় পাচ্ছি না। যেকোনো জল থেকে তুমি বললেই আমি তোমার জন্য শাপলা ফুল নিয়ে আসতে পারি। তোমার জন্য আমি সাঁতারটাও শিখে ফেলেছি। আচ্ছা অনু, আমি কি এখনো তোমার আঁকা ছবিতে আছি?
তুমি আমাকে এতগুলো কাগজ এনে দিতে বলেছিলে। ছবি আঁকার কাগজ। তোমার হাত-ভরতি লাল, নীল পেনসিল আর কাগজ নেই বলে মুখ গোমড়া করে বসে আছো, কী বিশ্রী ব্যাপার! আনি আনি করে আর আনা হয়নি আমার। তুমি বিশ্বাস করো, আর একটা দিন পেলেই আমি নিয়ে আসতাম ঠিক। আর কয়েকটা দিন পেলে ওয়ার্ড নামের কারাগার থেকে তোমাকে মুক্ত করে দিতাম। আর কয়েকটা মাস পেলে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম। আর কয়েকটা বছর পেলে তোমাকে জীবন দেখাতাম। একটা জীবন তুমিও দেখে ফেলেছিলে। খুব কষ্টের জীবন, পূর্ণ না হওয়া স্বপ্নের জীবন, থমকে থমকে থাকা মুহূর্তের জীবন।
আমি প্রতিদিন সকালে দেরি করে আসতাম বলে প্রফেসর স্যার আমাকে বকতেন। সবার সামনে বকুনি খেয়ে মাথা নিচু করে আছি আর কোথা থেকে একটা খিলখিল হাসি আসছে। আমি চেয়ে দেখি একটা ছোট মেয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে মজা নিচ্ছে। খুব রাগ হচ্ছিল। না, মিথ্যা বললাম। এমন সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো মানুষ রাগ করতে পারে না? পরে জানলাম, আগের রাতেই তুমি এসেছিলে। তোমার অনেক অসুখ। হৃৎপিণ্ডটায় বিধাতা অকৃপণের মতো ছিদ্র দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। প্রায়ই তোমার শ্বাসকষ্ট হয়। দেশের, প্রতিবেশী একটা দেশের শিশুদের ওয়ার্ডগুলো তোমার মুখস্থ। শেষে এলে আমাদের অতিথি হয়ে। কয়েকটা দিন নাকে অক্সিজেনের নল ঢুকিয়ে তুমি আমার বন্ধু হয়ে এলে। ফাঁকিবাজ আমি ওয়ার্ডে বসে তোমার গল্প শুনি। ডিউটির বাইরে সাদা অ্যাপ্রোন পরে বসে থাকি। তুমি ছবি আঁকো। গল্প করো। তোমার বাসার গল্প, মা-বাবার গল্প, বারান্দার কোয়েলগুলোর গল্প। কোয়েলগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে খিটিমিটি করে রক্তাক্ত হয়ে যাওয়ার গল্প। গ্রামের বাড়িতে বিলের জলে শাপলার গল্প। আমি তোমাকে কোনো শাপলা এনে দিতে পারিনি। আমি তো সাঁতার জানতাম না, তাই।
সেদিন সকাল থেকেই তুমি ছটফট করছিলে। তোমাকে নেওয়া হলো আইসিইউতে। সারাটা দিন আমি পাগলের মতো, আমরা চেষ্টা করলাম। বুকের খাঁচাটা ভেঙে ভেঙে তুমি শ্বাস নিচ্ছিলে। আমি চোখের জল আটকাতে পারিনি, অনু। চিকিৎসকদের কাঁদতে নেই। আমি তো তখন চিকিৎসক নই, তোমার বন্ধু। নিষ্ঠুর মনিটরটা আমার সঙ্গে তখন প্রতারণা করছে। ইসিজিটা ধীরে ধীরে নিস্তরঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, রক্তে অক্সিজেন ধুপ করে কমে যাচ্ছে, ক্লান্ত হৃৎপিণ্ডটা ছুটি চাইছে। একজন চিকিৎসক তোমার পাঁজরে চেপে চেপে সিপিআর দিচ্ছে আর আমি অসহায়ের মতো বসে আছি। তোমার একটা হাত আমার হাতে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে।
অনু, স্বর্গে কি নদী থাকে? সেই নদীতে শাপলা ফুল? আর পাশে সাদা সাদা কাশ? তুমি তাহলে সেখানে বসে ছবিই আঁকতে থাকো। আমি এখন আবার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে হাঁটতে থাকি। দেরি করে এসে স্যারের বকুনি খাই। এখন আর কেউ খিলখিল করে হাসে না।
প্রাণ খুলে হাসতে গেলেও যে হৃৎপিণ্ড ক্লান্ত হয়ে যায়, বেঁকে বসে, সেই অমূল্য হাসির জন্য আমি কাঁদতে থাকি, অনু।