বেসিসের পর অ্যাপিকটাও জিতেছে ঝিনাইদহ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা
নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ। তবু উদ্ভাবনের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একদল শিক্ষার্থী। দীর্ঘ গবেষণা আর কঠোর পরিশ্রমের পর তিনটি যন্ত্র তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। সর্বশেষ ইনস্টিটিউটের সাত শিক্ষার্থীর তৈরি ‘স্যানিটারি প্যাডের ভেন্ডিং মেশিন’ জিতে নিয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
১৫ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া থেকে অনলাইনে ঘোষণা করা হয় এশিয়া প্যাসিফিক আইসিটি অ্যাওয়ার্ড (অ্যাপিকটা) ২০২০-২০২১–এর বিজয়ীদের নাম। সেখানে ‘সিনিয়র স্টুডেন্ট’ ক্যাটাগরিতে জয়ী হয়েছে ঝিনাইদহ পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষার্থীদের তৈরি ‘স্যানিটারি প্যাডের স্মার্ট ভেন্ডিং মেশিন’। অ্যাপিকটার আগে এটি বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডও জিতেছে।
রোবটিকস ক্লাব থেকে এসেছে সাফল্য
শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁদের এই কাজের নেতৃত্বে ছিলেন তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান রবিউল ইসলাম। যদিও তিনি এই প্রতিষ্ঠান থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তবে তাঁর গড়া রোবটিকস ক্লাবই আজকের সফলতা এনে দিয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানের তড়িৎ বিভাগের শিক্ষক রবিউল ইসলাম শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কাজে যুক্ত করতে শুরু করেন। গড়ে তোলেন রোবটিকস ক্লাব। ধীরে ধীরে ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন প্রায় ৫০ জন। মূল গবেষণায় অংশ নেন বক্তিয়ার আহম্মেদ, হৃদয় হোসেন, কাউছার আহম্মেদ, সাব্বির হোসেন, দেবাশীষ কুমার বিশ্বাস, জান্নাতুল ফেরদৌস, মামুনুর রশিদ, আরিফ হাসান, তানভীন রহমান, ইনজয় ভদ্রা ও শারমিন আক্তার। তাঁদের পরিশ্রমে ২০১৯ সালে তৈরি হয় ‘অটোমেটিক হাউস ক্লিনার অ্যান্ড লাইফ সেফটি রোবট’। মূলত বাসার ময়লা পরিষ্কার করতে কাজে লাগে এই রোবট। এটি তৈরি করে তাঁরা বিজ্ঞান মেলাসহ নানা স্থানে প্রদর্শন করেন। এতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বিভাগীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হন শিক্ষার্থীরা।
আরও উদ্যম, আরও উদ্যোগ
পুরস্কার পেয়ে নতুন উদ্যমে আরও গবেষণায় যুক্ত হন শিক্ষার্থীরা। ২০২০ সালে তাঁরা তৈরি করেন ‘স্মার্ট অ্যাগ্রো রোবট’। খেতে বীজ ছিটানো, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোকামাকড় ধ্বংস করাসহ নানাভাবে রোবটটি কৃষিকাজে সহায়তা করতে সক্ষম।
সব শেষে তাঁরা তৈরি করেছেন স্যানিটারি প্যাডের স্মার্ট ভেন্ডিং মেশিন। গবেষণা দলের প্রধান হৃদয় হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশের মেয়েরা অনেক সময় দোকান থেকে স্যানিটারি প্যাড কিনতে বিব্রত বোধ করেন। কখনো কখনো অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মধ্যেও পড়তে হয়। তাই মেয়েরা স্যানিটারি প্যাড কিনতে দ্বিধা বোধ করেন। এই সমস্যার সমাধানেই আমরা তৈরি করেছি “আইওটি বেসড স্মার্ট ভেন্ডিং মেশিন ফর স্যানিটারি প্যাড”। কোনো দোকানির সাহায্য ছাড়াই সহজে মেশিন থেকে তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্যাড সংগ্রহ করতে পারবেন নারীরা।’ হৃদয় জানালেন, প্যাড সংগ্রহ করতে হলে গ্রাহককে মেশিনের ভেতর ১০ টাকার একটি নোট দিতে হবে।
দলের অন্যতম সদস্য শারমিন আক্তার বলেন, মেশিনের ভেতর প্যাড ফুরিয়ে গেলে মেশিন খুদে বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেবে। তখন নিয়ন্ত্রণকারীরা আবারও মেশিনে প্যাড ভরে দিতে পারবেন। একবারে মেশিনটিতে ২০০ থেকে ২ হাজার পর্যন্ত প্যাড রাখা যাবে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নারীরা যেন নিকটস্থ স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিনের অবস্থান জেনে নিতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া মেশিনের গায়ে লাগানো কিউআর কোড স্ক্যান করে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমেও পেমেন্ট করা যাবে।
প্রয়োজন সহায়তা
শিক্ষার্থীদের কথায় বারবার ঘুরেফিরে এল তাঁদের শিক্ষক রবিউল ইসলামের নাম। তাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার মতো পর্যাপ্ত সুবিধা ছিল না। নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে গবেষণাকাজে ব্যয় করেছি। প্রতিদিন ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস থাকত। এরই মধ্যে সময়-সুযোগ বের করে আমরা কাজ করেছি। কখনো কখনো রাত হয়ে গেছে, তবু শিক্ষার্থীরা কাজ চালিয়ে গেছে।’ রবিউল ইসলাম জানালেন, অন্যত্র বদলি হয়ে গেলেও এখনো মুঠোফোনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ, প্রকৌশলী সাজেদ-উর-রহমান বলেন, ‘একটা কিছু তৈরি করার যে উদ্যম শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ছাত্রছাত্রীরা যেন ভবিষ্যতেও উদ্ভাবনে আগ্রহী হয়, সে ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’