ব্যাটারিহীন ইলেকট্রনিক যন্ত্রের খোঁজে

বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা সম্ভাবনাময় তরুণদের নিয়ে প্রতি বৈশাখেই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। ১৪২৯ বঙ্গাব্দেও ক্রীড়া, অভিনয়, সংগীত, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, গবেষণা, অ্যাডভেঞ্চারে অগ্রগামী ৯ তরুণকে নিয়ে হাজির হয়েছে। এখানে পড়ুন গবেষক বাসিমা ইসলামের গল্প।

গবেষক বাসিমা ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

পার্কে অনেককেই দেখবেন দৌড় শেষ করে স্মার্টওয়াচ দেখছেন। আপনি কয় কদম হাঁটলেন, আপনার হৃৎস্পন্দন কত—সবই হিসাব রাখতে পারে এসব যন্ত্র। কিন্তু আইনজীবী শেখ বাহারুল ইসলামের কথা হলো, কিছুক্ষণ পরই তো চার্জ শেষ হয়ে যাবে! এখন কি তাহলে ঘড়িও চার্জ দিতে হবে?

তাঁর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ওরস্টার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক বাসিমা ইসলাম ভাবেন, এমন কিছু কি করা যায় না, যা ছোটখাটো যন্ত্রকে ব্যাটারি ছাড়াই চালাতে পারবে!

শূন্য থেকে আপনি নিশ্চয় শক্তি তৈরি করবেন না? প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে বাসিমা বললেন, ‘ছোটবেলায় আমরা শক্তির নিত্যতা সূত্র পড়েছি। আমরা শুধু শক্তির রূপান্তর করতে পারি। মানুষ যখন হাঁটে বা দৌড়ায়, তখন তার গতিশক্তি আসে তার গৃহীত খাবার থেকে। এই গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা সাইকেল চালাতে পারলেও সরাসরি কোনো যন্ত্রকে চালানো যায় কি না, সেটা ভাবা হয়নি। এ রকম পারিপার্শ্বিকতা থেকে শক্তি সংগ্রহ করাই ছিল আমার গবেষণা।’

ন্ধুদের নিয়ে ‘হ্যাপি ওয়াচ’ নামের এমন একটা ঘড়ি বানিয়েছিলেন বাসিমা
ছবি: সংগৃহীত

যেকোনো ইলেকট্রনিকস যন্ত্রেরই প্রাণ হলো ব্যাটারি। তবে মুশকিল হলো, নিয়মিত বিরতিতে আপনাকে সেটা বদলাতে হয়, নয়তো চার্জ দিতে হয়। বিশ্বখ্যাত সিলিকন চিপ কোম্পানি আইবিএমের হিসাব বলছে, সেমিকন্ডাক্টর চিপের কল্যাণে ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বে এ রকম যন্ত্রের সংখ্যা ১ ট্রিলিয়ন (১ লাখ কোটি) ছাড়িয়ে যাবে। নতুন কোনো উদ্ভাবন যদি না–ও আসে, তাহলেও প্রতিদিন বিশ্বে ২৫ কোটি ৬০ লাখ ব্যাটারি বদলাতে বা চার্জ দিতে হবে। এ জন্য কীভাবে কম বিদ্যুৎ খরচ করে ব্যাটারির জীবন বাড়ানো যায়, একবার চার্জ দিয়ে কয়েক দিন স্মার্টফোন চালানো যায়, এসব নিয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষণা করছেন একদল বিজ্ঞানী। পরিবেশের সাহায্য নিয়ে ভিন্ন কিছু করা যায় কি না, তা–ও ভেবে দেখছেন আরেক দল। একই ধারায় ছোট আইওটি ডিভাইসকে কীভাবে অল্প শক্তিতে চালানো যায়, তাই নিয়ে কাজ শুরু করলেন বাসিমা। আপনার হাঁটা বা দৌড়ানো থেকে আসবে এই শক্তি, আর সেই শক্তিই আপনার কদম গুনতে পারবে। কিংবা শরীরের যে তাপ, সেটা দিয়েই এমন আইওটি ডিভাইস চালানো যাবে, যা আপনার হৃৎস্পন্দনকে মেপে ফেলবে।

কম্পিউটারে ওয়ার্ডে লেখালেখি করার সময় যদি সেটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটি চালু করলে প্রথমে ‘বুট’ হয়, পরে আপনি আবার ওয়ার্ড চালু করতে পারেন। কিন্তু এমন ডিভাইসকে প্রতিবারই যদি শুরু থেকে শুরু করতে হয়, তাহলে সেখানেই খরচ হয়ে যাবে অনেক শক্তি। কাজেই কম্পিউটার গবেষকদের যাঁরা ইন্টারমিটেন্ট কম্পিউটিং নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাজ হলো যেখানে বন্ধ হয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু করতে পারা। তাহলেই আমরা পেয়ে যাব ‘ব্যাটারিবিহীন আইওটি’ ডিভাইস।

২০১০ সালে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর বাসিমা ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। স্মার্টওয়াচ আসার আগেই ২০১২-১৩ সালে, বন্ধুদের নিয়ে ‘হ্যাপি ওয়াচ’ নামের এমন একটা ঘড়ি বানিয়েছিলেন বাসিমা, যা পদক্ষেপের সংখ্যা ও হৃৎস্পন্দন মাপতে পারে। স্মৃতি হাতড়ে বাসিমা বলছিলেন, ‘কিন্তু ডিভাইসটির ৭৫ শতাংশই ছিল ব্যাটারি। তারের জটিল জটের ভেতর থেকে ব্যাটারি বদলানোটাই ছিল একটা বিশ্বজয়ের শামিল।’

বাসিমা ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের স্নাতক
ছবি: সংগৃহীত

২০১৩ সালে মাইক্রোসফটের ইমাজিন কাপে ‘গ্লোবাল ফাইনালিস্ট’ হয় বাসিমার সে প্রকল্প। পরে যখন ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা অ্যাট চ্যাপেল হিলে পিএইচডি করতে গেলেন তখনো এই বিষয়কেই বেছে নেন বাসিমা। এর পরের গল্প আমরা জানি। গবেষণার জন্য এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফোর্বস–এর ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’-তে জায়গা করে নিয়েছেন বাসিমা ইসলাম। বিজ্ঞান শাখায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

আইনজীবী শেখ বাহারুল ইসলাম ও ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক লাইলুন নাহারের দুই মেয়ের মধ্যে বাসিমা ছোট। বোস্টনে স্বামী প্রকৌশলী তামজীদ ইসলামের সঙ্গে তাঁদের সংসার।

অবসরে আড্ডা দিতে, বই পড়তে এবং ঘুরতে ভালোবাসেন বাসিমা ইসলাম।

লেখক: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান