
শৈশবে পিঠাপিঠি ভাইবোনের মধ্যে যতই খুনসুটি হোক না কেন, দিনের শেষে তা মধুরতার মধ্য দিয়েই শেষ হয়। ছোটবেলায় ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা কম দেখা যায়। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে পরিণত বয়সে নানা বৈষয়িক কারণে ভাইবোনের এই মধুর সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরে এবং ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতার বদলে পারস্পরিক অশ্রদ্ধা আর অবিশ্বাস জন্ম নেয়। শৈশবে ও পরিণত বয়সেও যাতে ভাইবোনের সম্পর্ক অটুট থাকে, সে জন্য বাবা-মায়েরা কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। যেমন:
সমান দৃষ্টিতে দেখুন: আপনার একাধিক সন্তান থাকলে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখুন। স্নেহ-শাসনের বেলায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখুন। কোনো সন্তান যেন কখনোই মনে করতে না পারে যে সে তার ভাই বা বোনের চেয়ে কম স্নেহ বা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। আবার কেউ যেন নিজেকে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবেও গণ্য না করে।
আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখান: সন্তানের নিজের আবেগের বহিঃপ্রকাশ, অপরের আবেগকে ধারণ করার ক্ষমতা শেখাতে হবে। সবার আগে বাবা-মায়ের নিজেদের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। পাশাপাশি সন্তানের কোনো আবেগ নিয়ে ব্যঙ্গ করা, উত্তেজিত হওয়া চলবে না। ভাইবোনের মধ্যে পারস্পরিক আবেগকে মূল্য দেওয়া শেখাতে হবে। বোঝাতে হবে একজনের কষ্ট মানে আরেকজনেরও কষ্ট, একজনের আনন্দ মানে আরেকজনেরও আনন্দ।
পারস্পরিক খেলার সুযোগ দিন: সন্তানদের নিজেদের মধ্যে খেলার সুযোগ করে দিন। ‘ও ছোট, আমার খেলা বুঝবে না’ বা ‘ও অনেক বড়, আমাকে খেলায় নেয় না’—এ ধরনের কথা যাতে শিশুরা বলতে না পারে, সে জন্য দুজনের উপযোগী একই খেলা খেলতে উৎসাহিত করুন।
মনোমালিন্য হলে হস্তক্ষেপ নয়: ছোট ভাইবোনদের মধ্যে তুচ্ছ কারণে মনোমালিন্য হতে পারে। সব ক্ষেত্রে বিচারকের ভূমিকায় মা-বাবার না যাওয়া ভালো। তাদের সমস্যার সমাধান তাদের করতে দিন। কখনো কখনো সমস্যাটি দেখেও না দেখার ভান করুন।

নালিশকে নিরুৎসাহিত করুন: একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ বা যে কারও বিরুদ্ধে নালিশকে নিরুৎসাহিত করুন।
তুলনা নয়: কখনো এক সন্তানকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করবেন না। এতে একজনের মধ্যে হীনম্মন্যতা আর আরেকজনের মধ্যে অহমিকা তৈরি হতে পারে। সন্তানের মধ্যকার ইতিবাচক দিকটি বের করে সেটাকে উৎসাহিত করতে হবে। কেউ পড়ালেখায় ভালো, আবার কেউ ছবি আঁকায়। যার যার গুণটিকে প্রশংসা করুন। একজনকে আরেকজনের মতো করার চেষ্টা করবেন না।
পারিবারিক সময় দিন: পরিবারের সবাই মিলে সপ্তাহের অবসর সময়টুকু একসঙ্গে কাটান। দায়িত্ব পালন আর অবসরকে একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলবেন না। প্রতিদিন সন্তানকে স্কুলে পৌঁছানো, খাওয়ানো, পড়তে বসানোটা দায়িত্ব আর এর বাইরে তাদের সঙ্গে বসে গল্প করা, সিনেমা দেখা বা বেড়াতে যাওয়াটা হচ্ছে দায়িত্বের চেয়ে বেশি কিছু। এই ‘বেশি কিছু’টাকে বলা হয় গুণগত সময়। আপনার সন্তানকে যত বেশি গুণগত সময় দেবেন, সন্তান ততই মানসিকভাবে শক্তিশালী হবে।
দলগত কাজ দিন: সন্তানদের একসঙ্গে এমন একটি কাজ দিন, যা তারা দু-তিনজন মিলে করতে পারে। আলাদা আলাদা দায়িত্ব না দিয়ে তাদের সবাইকে এমন একটা দায়িত্ব দিন, যা তারা টিমওয়ার্ক হিসেবে করতে পারে। এতে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে এবং পরস্পরের সঙ্গে মিলে কাজ করার গুণটি জন্ম নেবে।
কীভাবে না বলতে হয় সেটা শেখান: উগ্রতা না দেখিয়েও কীভাবে ‘না’ বলতে হয়, সেটা সেখান। সবকিছু যে গ্রহণ করতেই হবে তা নয়, জীবনে কিছু জিনিসকে বর্জনও করতে হবে। কীভাবে আপনার সন্তানেরা অপরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ‘না’ বলবে, সেটি শেখান। এই শ্রদ্ধামিশ্রিত ‘না’ বলাটা পরিণত বয়সে তাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
কোনো খারাপ উদাহরণ নয়: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাবা-মায়েদের জীবনাচার। তাঁরা কীভাবে তাঁদের নিজেদের ভাইবোনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছেন, তাঁরা কীভাবে নিজের ভাই বা বোনকে নিয়ে কথা বলছেন তা শিশুর জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিশু যদি দেখে তাদের বাবা-মায়েরা তাদের চাচা-মামা-ফুফু-খালাদের সঙ্গে মোটেই সুসম্পর্ক রাখতে পারছেন না, অশ্রদ্ধা আর অবিশ্বাসের তিক্ত সম্পর্ক তৈরি করছেন, তখন শিশুদের নিজেদের মধ্যে এর প্রভাব পড়ে। পরিণত বয়সে তাদের নিজেদের মধ্যেও এটা প্রতিফলিত হয়। তাই নিজের শিশুকে পরিবর্তন করতে হলে বাবা-মায়েদের উচিত সবার আগে নিজেদের পরিবর্তন করা।
([email protected])
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল, ঢাকা