ভাবি এলে ভাই দূরে?

ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। খুনসুটি, হাসি-আনন্দে কাটত সারাক্ষণ। কিন্তু ভাইয়ের বিয়ের পর ভাবিকে যেন একদমই সহ্য করতে পারল না ছোট বোন। বোনের মনে হতে থাকল, ভাবির কারণে ভাই তার থেকে দূর সরে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী করতে থাকল ভাবিকে। একসময় ভাবি-ননদের সম্পর্কটি তিক্ত হয়ে যায়।
ভাবি ও ননদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়াটা খুব প্রত্যাশিত হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এ সম্পর্ক একটা টানাপোড়েনের জায়গায় গিয়ে ঠেকে। ছেলেবেলা থেকে একই সঙ্গে বেড়ে উঠতে উঠতে ভাইয়ের ওপর বোনের যে অধিকারবোধ তৈরি হয়, ভাবির আগমনে সে সম্পর্কের মাধুর্যের ক্ষেত্রে একধরনের অনিশ্চয়তাবোধ তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া একেবারে ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা, ভিন্ন জীবনাচরণে অভ্যস্ত একজন মানুষকে নিজ পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নেওয়া অনেক সময় অনেকের জন্য সহজ হয় না। এ কারণে সম্পর্কের শুরুতেই তৈরি হতে পারে দ্বন্দ্ব।
নতুন ভাবির প্রতিটি কাজেই ভুল ধরা, খোঁচা মেরে কথা বলা, সমালোচনা করা ইত্যাদি সম্পর্কটা সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে দেয় না। অপর দিকে পরিবারের বউ-শাশুড়ি, ভাবি-ননদ সম্পর্কগুলো নিয়ে কেউ কেউ আগেই একধরনের বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। তাঁদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেন। স্বামীর প্রতি একধরনের একক আধিপত্যবোধের কারণেও কেউ কেউ উদার থাকেন না। অর্থাৎ, ভাবি-ননদের সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকলে তার দায়ভার দুই পক্ষেরই। ভাবি ও ননদের সম্পর্কের দূরত্ব শুধু এ সম্পর্কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, তিক্ততার আঁচ স্বামী-স্ত্রী বা ভাইবোনের সম্পর্কে এসেও লাগে। ফলে, আমাদের মনের এসব জটিলতা সরিয়ে যদি সম্পর্কগুলো একটু সহজভাবে দেখতে পারি, তাহলে জীবন স্বাভাবিক ও সুন্দর হয়।
আর যেকোনো মানুষকে তাঁর দোষ-গুণসহ গ্রহণ করার মনোভাব থাকলে পারস্পরিক আস্থার একটা চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব।
ননদের করণীয়
মানসিক প্রস্তুতি: ভাইয়ের বিয়ের আগে থেকেই নতুন ভাবির বিষয়ে একধরনের মানসিক প্রস্তুতি থাকা ভালো। এ ছাড়া বিয়ের পর ভাইয়ের জীবনযাত্রাতেও যে কিছুটা পরিবর্তন হবে, দায়িত্বের জায়গা বাড়বে, সেটা মেনে নেওয়ার মনোভাব তৈরি করা উচিত।
পরিবারে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করা: প্রথমত, পরিবারে আসা ভাবিকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া উচিত। তাঁর নিজস্বতা, স্বকীয়তাকে সম্মান দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে তাঁর সবকিছু শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের পছন্দমতো হতে হবে, এমন মনোভাব না থাকাই ভালো।
সমালোচনা নয়: সরাসরি সমালোচনা করা, প্রতিটি কাজে ভুল ধরা, মনে আঘাত দিয়ে কথা বলা ইত্যাদি কখনোই একটা সম্পর্ককে আস্থাশীল করে না। তাই যত দূর সম্ভব এগুলো পরিহার করা ভালো।
নালিশ বা অভিযোগ নয়: অনেক ক্ষেত্রেই ভাবির নানা অপছন্দের বিষয় নিয়ে ভাইয়ের কাছে নালিশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে নালিশের পরিবর্তে সমস্যা নিয়ে ভাবির সঙ্গেই কথা বলা ভালো। সমস্যাগুলো নিয়ে এমনভাবে বলতে হবে, যাতে তাঁর মনে আঘাত না লাগে। মনে রাখা উচিত, এ ধরনের নালিশ শুধু ননদ-ভাবির সঙ্গেই দূরত্ব তৈরি করে না, ভাইয়ের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। ভাবিকে বলতে সংকোচ লাগলে ভাইকে নালিশ না করে বুঝিয়ে বলা যেতে পারে।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক: যেকোনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক আস্থা, সম্মানবোধ ও শর্তহীন গ্রহণযোগ্যতা। পরস্পরের সঙ্গে সময় কাটানো, যেমন: একসঙ্গে ঘোরা, গল্প করা, ভালো লাগা-মন্দ লাগা ভাগাভাগি করা, মজা করা ইত্যাদির মাধ্যমে একটি চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।
ভাই এবং স্বামী
স্ত্রী ও বোনের সম্পর্কের টোনাপোড়েনে অনেক সময় ভাইয়ের অবস্থান একটু নাজুক থাকে। তার পরও এ ক্ষেত্রে তাঁর বলিষ্ঠ এবং কিছুটা কৌশলী ভূমিকা ভাবি ও ননদের ইতিবাচক সম্পর্কে ভূমিকা রাখতে পারে।
স্ত্রী বা বোন কারও সামনেই অপরের সম্পর্কে অকারণে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না করা ভালো। এ ক্ষেত্রে আপনার সরল উচ্ছ্বাস যুক্তির বেড়াজাল ছাপিয়ে অন্যের মনঃকষ্টের কারণ হতে পারে।
অভিযোগে প্রশ্রয় নয়: স্ত্রী বা বোন পরস্পর সম্পর্কে অভিযোগ করলে যথাসম্ভব প্রশ্রয় না দেওয়াই ভালো। অভিযোগে প্রভাবিত না হয়ে স্ত্রী বা বোন সম্পর্কে আপনার নিজস্ব যে বিবেচনা, সেটাই মূল্যায়ন করা উচিত।
সমালোচনা না করা: একজনের সামনে অন্যজনকে ঠাট্টাচ্ছলে বা দুষ্টুমি করেও হেয় করা থেকে বিরত থাকুন।
ভাইবোনের সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা: অনেক সময় ভাবির কারণে ভাইয়ের কাছ থেকে দূরত্বের আশঙ্কা কাজ করতে পারে। ভাইবোনের সম্পর্কটি যে আগের মতোই আছে, সেটা আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কিন্তু ভাইয়ের। বোনের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, যেকোনো প্রয়োজন আগের মতোই মনোযোগ দিন। বোনের প্রতি ভালোবাসা যে আপনার আগের মতো আছে, সেটা নানাভাবে প্রকাশ করুন।
স্ত্রীকে সময় দেওয়া: দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে ঘোরা, একান্তে সময় কাটানো ইত্যাদির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। পরিবারে স্ত্রীর সুবিধা-অসুবিধা বোঝার চেষ্টা করুন এবং নতুন পরিবেশের সঙ্গে তাঁকে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করুন।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ