ভার তুলে নির্ভার স্মৃতি

ভারোত্তলনে অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন স্মৃতিছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ছোটখাটো গড়নের স্মৃতি আক্তারকে দেখে বোঝার উপায় নেই কতখানি ভার বইতে পারেন নিজের কাঁধে! সাত বছর ধরে সংসারের ভার একাই বয়ে চলেছেন। ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ, অসুস্থ মায়ের ওষুধ, পছন্দের কেনাকাটা—সব ইচ্ছা পূরণ করেন নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে। স্মৃতির এতসব সম্ভব হয়েছে ভার তুলেই। মানে ভারোত্তোলন খেলার সুবাদে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে ৫৫ কেজি ওজন শ্রেণিতে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছেন স্মৃতি। শুধু এটুকুতেই স্মৃতির সোনা জয়ের মাহাত্ম্য বোঝানো কঠিন। নেপালে ২০১৯ সালে সর্বশেষ এসএ গেমসে রুপা জেতা ফুলপতি চাকমাকে হারিয়ে এবার জিতেছেন সোনা। ভারোত্তোলনে গড়েছেন নতুন জাতীয় রেকর্ড।

স্মৃতির ভারোত্তোলন খেলতে আসার গল্পটা মজার। ঢাকার পল্টনের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনের পাশে ছিল স্মৃতির বাবা আবদুল মোতালেবের চা-সিগারেটের দোকান। স্কুল ছুটি হলে প্রায়ই বাবার টংদোকানে গিয়ে বসতেন স্মৃতি। বাবাকে সাহায্য করতেন বেচাকেনায়। সেখানে বিভিন্ন সময়ে চা খেতে আসতেন বিভিন্ন খেলার কোচ, খেলোয়াড়েরা। ভারোত্তোলনের কোচ মজিবর রহমানও আসতেন সেই দোকানে। একদিন স্মৃতিকে দেখে মোতালেবকে বলেন, ‘তোমার মেয়েকে খেলায় দেবে?’ মোতালেব রাজি হয়ে গেলেন।

ভারত্তোলনে একের পর এক সাফল্য পাচ্ছেন স্মৃতি
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

২০১৩ সালে প্রথম ভারোত্তোলন খেলা শুরু স্মৃতির। খেলার সুবাদে ২০১৪ সালে চাকরি পেয়ে যান সেনাবাহিনীতে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্মৃতির।

চায়ের দোকানের সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন আবদুল মোতালেব। দুই ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন প্রায় ১০ বছর। গত বছর মারা গেছেন স্মৃতির বাবা। অনেক আগে থেকেই সংসারের পুরো দায়িত্ব স্মৃতির কাঁধে। বাবা নেই, ভাইয়েরাও কোনো দায়িত্ব নেন না। সত্যি সত্যিই স্মৃতির কাঁধে এখন সংসারের সবটুকু ভার।

আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণির পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি স্মৃতির। মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করার ইচ্ছা ছিল আবদুল মোতালেবের। কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। শেষ পর্যন্ত মেয়ের সেনাবাহিনীতে চাকরি হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন বাবা। চাকরির প্রথম বেতনের টাকা যেদিন বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, স্মৃতির চেয়ে খুশি আর কেউ ছিলেন না, ‘সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারব না। প্রথম বেতন পেয়েছিলাম সাড়ে চার হাজার টাকা। সব টাকা এনে বাবার হাতে দিয়েছিলাম। দোকানে বসে সবাইকে বলছিলেন, “আমার মেয়ে রোজগার করেছে। আনন্দে বাবা কেঁদে দিয়েছিলেন।”’

স্মৃতির বড় দুই ভাই উপার্জন করলেও সংসারের কোনো দায়িত্ব নেন না। যে দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল ভাইদের, সেটাই পালন করেন স্মৃতি। ছেলের মতোই সংসারটা আগলে রাখেন তিনি, ‘মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে আমার কোনো দুঃখ নেই। বাবা আমাকে ছেলের মতোই মনে করতেন। খেলার সুবাদে সেনাবাহিনীর চাকরি করছি, এটা অনেক সম্মানের। অনেক গর্বের। মা-বাবার সব দায়িত্ব নিতে পেরে বেশি ভালো লাগে আমার।’

খেলার সুবাদে ঘুরে এসেছেন মিসর, থাইল্যান্ড ও নেপাল। মিসরে খেলেছেন ইসলামিক সলিডারিটি চ্যাম্পিয়নশিপে, থাইল্যান্ডে বিশ্ব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে এবং নেপালে এসএ গেমসে।

ভার তুলে জীবন বদলে গেছে অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা এসএ গেমসে সোনাজয়ী মাবিয়া আক্তারের। দেশের সেরা ভারোত্তোলক মাবিয়াকেই আদর্শ মানেন স্মৃতি, ‘মাবিয়া আপুর মতো খেলতে চাই আমি। ২০২৪ সালের অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করতে চাই। তবে সবার আগে এসএ গেমসে সোনা জিততে হবে।’

মাঝেমধ্যে অবশ্য স্মৃতির বিয়ের কথা তোলেন মা। কিন্তু খেলা নিয়েই আপাতত সব ভাবনা স্মৃতির, ‘এখনই বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছি না। আমার সব মনোযোগ ভারোত্তোলনে।’

সংসারের ভার তো নিয়েছেন আগেই। ভারোত্তোলনের বিশ্বমঞ্চেও একদিন লাল-সবুজের ভারটা নিতে চান নিজের কাঁধে তুলে।