
৬৬ জন কিশোরী এসেছে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা থেকে। জায়গা ভিন্ন হলেও সবাই একই চেতনায় উদ্বুদ্ধ। এরা ‘স্বর্ণ কিশোরী’। এই মেয়েরা সব বাধা পেরিয়ে আজ একসঙ্গে হয়েছে। লক্ষ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তোলা। শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় নিজেদের বন্দী করে রাখতে চায় না। নিজেকে জানা, নিজেকে ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে তারা পূরণ করতে চায় তাদের স্বপ্ন। কাঁধে তুলে নিতে চায় পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টানোর দায়িত্ব।
‘তুমি এখন কী চাও?’ উত্তরে শারমিন আক্তার সরলভাবে প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি আপনাকে মা বলে ডাকতে পারি? প্রশ্নকর্তা আবেগে জড়িয়ে ধরেছিলেন কিশোরী মেয়েটিকে। নিজের বাল্যবিবাহ রুখতে নিজের মায়ের বিরুদ্ধে চলে যায় শারমিন আক্তার। ফারজানা ব্রাউনিয়া হয়ে যান শারমিনের মা। শুধু শারমিন আক্তার নয়, স্বর্ণ কিশোরীর প্রতিটি কিশোরীর কাছে ফারজানা ব্রাউনিয়া প্রিয় ব্যক্তিত্ব। হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় স্বর্ণ কিশোরীর মেয়েরা সেই কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল। তারা বড় হয়ে ফারজানা ব্রাউনিয়ার মতো হতে চায়। বাংলাদেশের দুই কোটি কিশোরীকে সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবন দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা ব্রাউনিয়া। ‘স্বর্ণ কিশোরী’ তেমনই একটি কর্মকাণ্ড।
২০১১ সালের কথা। ফারজানা ব্রাউনিয়া তখন উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেন টেলিভিশনের পর্দায়। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর প্রথমবারের মতো চিন্তাটা মাথায় এল। হবু মায়েদের জন্য টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। অনেক কিছুই আছে যা অনেকে জানেন না। ‘আমি মা হতে চলেছি’ অনুষ্ঠানটি করার পর বুঝলেন আসলে আরও অনেক আগে থেকেই মেয়েদের সচেতন হতে হবে। প্রথম মাসিক হওয়ার পর তাঁদের সচেতন করতে হবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। স্বর্ণ কিশোরীর পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেল তখন থেকেই। ফারজানা ব্রাউনিয়া বলেন, ‘একটি কিশোরী মেয়ের নিজের শারীরিক ও মানসিক বিষয়ে জানার অনেক তথ্য আছে। এগুলো জানলে ওরা পৃথিবী পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে। কারণ নিজেকে পরিবর্তন করা মানেই পৃথিবী পরিবর্তন করে ফেলা। তারা ঠিক তো পৃথিবী ঠিক।’
স্বর্ণ কিশোরীর শপথ চারটি—এক. আঠারো বছরের আগে বিয়ে নয়। দুই. বিশ বছরের আগে গর্ভধারণ নয়। তিন. ভাই আর বোন পুষ্টিকর খাবারে সমান দুজন। চার. বয়স ১৫ বছর যখন টিটি টিকার (ধনুষ্টংকার) পাঁচ ডোজের শুরু তখন। মূল লক্ষ্য হলো নিরাপদ মাতৃত্ব।
ফারজানা ব্রাউনিয়া শপথগুলো ব্যাখ্যা করেন, ‘এই সব শপথ একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িত। সুস্থ জীবন হলে শিক্ষাজীবন সহজে আসবে। এরপর অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন শুরু হবে। শেষ ক্ষমতায়নটি হলো কোন বয়সে সন্তান নেবে সে বিষয়টি নিজেই ঠিক করতে পারবে। এটি যেদিন হবে সেদিন মাতৃমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।’

ফারজানা ব্রাউনিয়া বলেন, ‘চার বন্ধু মিলে স্বর্ণ কিশোরীর পাঁচ বছরের পরিকল্পনা ঠিক করেছি। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি অথবা প্রয়োজনবোধে একটু বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর ১৫ মিনিটের মধ্যে স্বাস্থ্যজ্ঞান সম্পর্কে প্রশিক্ষিত ১৫ হাজার মেয়ের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ করব। বাকি এক দিনের মধ্যে ২ কোটি মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে এই পনেরো হাজার মেয়ে। প্রথম বছরে আমরা সাতটি বিভাগে ২০টি স্বর্ণ কিশোরী বিদ্যালয় তৈরি করেছি। দ্বিতীয় বছর ৬৪টি জেলায় ৬৪টি বিদ্যালয় তৈরি করেছি। ভবিষ্যতে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়েও বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।’ এই স্কুলগুলো এখন স্বর্ণ কিশোরীর নেটওয়ার্কভুক্ত বিদ্যালয়। এখান থেকে ওরা শিখবে সুস্বাস্থ্য এবং জীবনে ভালো থাকার উপায়। সরকারের বেশ কটি মন্ত্রণালয়, বেসরকারি সংস্থা ও জাতিসংঘের একটি সংস্থা এই উদ্যোগকে সহযোগিতা করছে।
৬৪টি জেলায় লিখিত পরীক্ষা ও উপস্থিত বক্তৃতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেরা ৬৪জন মেয়েকে বাছাই করা হয়েছে। দেশের সবকটি জেলায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতেই তাদেরকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই জাতীয় কনভেনশনে নিয়ে আসা হয়। পরে এদের সঙ্গে আরও দুজন এসে যোগ দেয়। এখানে তারা তথ্যপ্রযুক্তি, গণমাধ্যম ও সুস্বাস্থ্য বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এর বাইরে সংগ্রামী, প্রতিবাদী হিসেবে শারমিন আক্তারকে বাছাই করা হয়েছে। যে নিজের বাল্য বিয়ে ঠেকিয়েছিল।
টেলিভিশনের পর্দায় (চ্যানেল আই) প্রশ্ন দেখে সবচেয়ে বেশি সঠিক উত্তরদাতাও ঢাকায় এসে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি নম্বর যে পাবে পুরস্কার হিসেবে সে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস ঘুরে আসার সুযোগ পাবে। ১৯ নভেম্বর থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। ঢাকায় এসে বেশ কিছু প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়েও যাচ্ছে ওরা। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রশিক্ষণ নেওয়ায় পরবর্তী সময়ে স্কাইপে, ই–মেইল ইত্যাদি মাধ্যমে যোগাযোগ করবে। ওদের স্কুলের কার্যক্রমও পরিচালনা করবে। এরপর আসবে গণমাধ্যমের প্রশিক্ষণ। কী করে গণমাধ্যমের মাধ্যমে সংগ্রাম করা যায়। আরও আছে স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ। যেটা স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো আয়োজন করেছে। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ লিমিটেডের ‘ইয়েস শি ক্যান’ প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক স্বর্ণ কিশোরীকে ল্যাপটপ কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। ২০ নভেম্বর ঢাকায় মাইক্রোসফট বাংলাদেশের কার্যালয়ে কম্পিউটারের প্রাথমিক ব্যবহার, ইন্টারনেট, এমএস অফিস, ভিডিও কল ইত্যাদির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই কিশোরীরা ঘুরে বেরিয়েছে শহীদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অভিভূত হয়েছে লাতিন আমেরিকার গানের সুরে। গতকাল ২৪ নভেম্বর নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছে সবাই। সঙ্গে নিয়ে গেছে তথ্যভান্ডার, এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। তাদের সঙ্গে তো আছেন ফারজানা ব্রাউনিয়া। তাদের মা।