ভালোবাসি বলি যেভাবে

মনের কথাটা অভিনব উপায়ে বললে হয়তো প্রেম হয়ে যেতেও পারে। মডেল: সায়রা ও বাপ্পা, ​ছবি: অধুনা
মনের কথাটা অভিনব উপায়ে বললে হয়তো প্রেম হয়ে যেতেও পারে। মডেল: সায়রা ও বাপ্পা, ​ছবি: অধুনা

তানভীর হায়দার ও নাদিয়া সুলতানা নবদম্পতি। এক মাসের বেশি হয়েছে তাঁদের বিয়ের। গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখটা তাঁরা নিশ্চয়ই সারা জীবন মনে রাখবেন। নাদিয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছেন। পরিচিত ‘বড় ভাই’ তানভীর তাঁকে ‘চলো একটু ঘুরে আসি’ বলে পথে নামলেন। গাড়ি একসময় গিয়ে থামল ঢাকার কুড়িলের ৩০০ ফুট রাস্তায়। গাড়ি থেকে নেমে নাদিয়া দেখলেন, রাস্তার একপাশে একদল তরুণ হাতে ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যানারে যা লেখা ছিল, তার সারমর্ম অনেকটা এ রকম, ‘আমার জীবনবৃত্তান্তটা কি তোমার মা-বাবার কাছে পৌঁছে দেবে?’ বুঝতেই পারছেন, বার্তাটির নিচে লেখা ছিল তানভীরের নাম।

বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তানভীর হায়দার বললেন, ‘আমরা শুধু পরিচিত ছিলাম। কথাবার্তা হতো। এদিকে বিয়ের বয়স হয়েছে। যেহেতু প্রেমট্রেম হয়নি, তাই দুজনের স্মরণীয় কোনো স্মৃতিও নেই। মনে রাখার মতো একটা কিছু করার জন্য প্রেম নিবেদনের অমন একটা উপায় বের করেছিলাম।’

তানভীর যে সফল, তা না বললেও চলে। তিনি হয়তো সফল হয়েছেন অমন অভিনব প্রেম নিবেদনের কারণেই। অভিনব না হলেও সৃজনশীল যেকোনো নিবেদনই কার না হৃদয় ছুঁয়ে যায়! যেমনটা গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার লাবণ্যর। অমিত যখন বলল, ‘...দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর্‌।/ ভালোবাসিবারে দে মোরে অবসর।’ স্বাভাবিকভাবেই লাবণ্যর কণ্ঠে মুগ্ধতার প্রকাশ ছিল, ‘আপনি বাংলা কবিতা লেখেন নাকি।’

এখন হয়তো কাগজে-কলমে কবিতা লিখে প্রেম নিবেদনের সেই চল কমে গেছে। কিন্তু প্রেম নিবেদন তো প্রায় প্রতি মুহূর্তেই হচ্ছে কোথাও না কোথাও। তাহলে ভালো লাগার মানুষটাকে কী করে নিজের মনের কথা বলবেন? সংগীতশিল্পী কনা বললেন, ‘আমি গান গাই, তাই ভালোবেসে ভালোবাসার একটা গান গেয়ে ফেলতে পারি। যিনি গান গাইতে পারেন না, তিনি হয়তো ভালো একটা ছবি আঁকতে পারেন। আর কিছু না হলে কথা তো বলতে পারেন। অতএব, তাঁকে ওই কথা দিয়েই প্রকাশ করতে হবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

আর যদি কথা বলতেও বুক কাঁপে, তাহলে? হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘রূপা’ গল্পটা নিশ্চয়ই পড়েছেন আপনি।

গল্পের নায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে ‘দীর্ঘ পল্লব আর ছায়াময় চোখে’র রূপার প্রেমে পড়ে গেল। এদিকে বেচারার তোতলামির সমস্যা। রূপার সঙ্গে কথাও হয়নি কোনোদিন। অথচ তাকে না দেখলে মহসিন হলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে ‘সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান’ ঘটানোর মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও ভাবে সে! অতঃপর একদিন একটা চিঠি লিখে রূপার বাসার নিচে যায় সে। চিঠি পৌঁছে যায়, কিন্তু রূপার কোনো দেখা নেই, নেই কোনো বার্তাও। আকাশ উপুর বৃষ্টিতে ভিজে ‘আমরণ অনশন’ শুরু করে গল্পের নায়ক। রাত যখন গভীর, তখন রূপা এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। নায়ক বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করে, এই রূপা সেই রূপা নয়! কিন্তু তাতে কী, একসময় নতুন এই রূপাকেই ভালোবেসে ফেলে সে। হয়তো নকল এই রূপা দেখতে আসল রূপার মতো ছিল না। কিন্তু ভালোবাসায় কেবল বাহ্যিক রূপটাই যে সব নয়। যেমনটা বলছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী, ‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে, যেটা বাংলায় বলা যায়, “কেউই সুন্দর নয়, সবাই সুন্দর।” ভালোবাসার সম্পর্কে শ্রদ্ধাটাই বড় কথা। প্রেম নিবেদনের আগে অবশ্যই ভালো লাগার মানুষটার প্রতি আপনার শ্রদ্ধা-সহানুভূতি থাকতে হবে।’ সহানুভূতির কথাই যখন এল, তখন একটা সিনেমার কথা বলা যায়—ব্রিজ টু টেরাবিথিয়া।২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটা মূলত কিশোর উপযোগী। গল্পের পাত্রপাত্রীও কিশোর। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা ভাব হয়ে যায়। স্কুল বাসে করে বাসায় ফিরছিল সবাই। স্কুলে ভর্তি হওয়া নতুন একটা মেয়ে বাসে উঠে বসে পেছনের দিকের একটা আসনে। সে জানত না, আসনটা ছোটদের ত্রাস হিসেবে পরিচিত এক মেয়ের অলিখিত সম্পদ। ত্রাস যদি দেখে তার আসনে কেউ বসেছে, তাহলে আর রেহাই নেই। গল্পের নায়ক বিপদ আঁচ করে নতুন মেয়ে, অর্থাৎ নায়িকাকে তার পাশের আসনে বসায়। ব্যস, ভাব হতে আর কতক্ষণ লাগে!

এ রকম কাকতালীয়ভাবে যদি কিছু না হয়, তাহলে কি আপনার ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে না? ছিঁড়বে, যদি আপনি সাহস করে শামসুর রাহমানের ওই কবিতাটা বলে ফেলতে পারেন, ‘মানুষ আমি আমার চোখে চোখ রেখে/ যদি বলো, “তুমি একান্ত আমার”, কী করে থাকব নির্বাক?/ তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, “আমি তোমার, তুমি আমার।”’ আর গানের গলা থাকলে সংগীতশিল্পী জেমসের গাওয়া একই কথার এই গানটা শুনিয়েও দিতে পারেন।

আর তা না হলে কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণের ভাষায় বলতে হয়, ‘এতই যদি দ্বিধা তবে জন্মেছিলে কেন?’ একই কবি অবশ্য আরেক কবিতায় সমাধানও দিয়েছেন, ‘আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই/ বলে দেব স্ট্রেটকাট: “ভালোবাসি”।’

>

কবি আনিসুল হকের ৫ দফা পরামর্শ

১. কাউকে ভালো লাগলে ব্যাকুল হবেন না। তাকে না পেলে চলবে না, তাকে না পেলে বাঁচব না—এমনটা ভাবলেই বিপদ। চেষ্টা করুন নিজের সবকিছুতে শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে। আপনার চলাফেরায়, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করুন। তবে তা বিনয়ের সঙ্গে। কখনোই শো-অফ করতে যাবেন না।

২. ছেলেরা যেমন সৌন্দর্যের পূজারি, মেয়েরাও ছেলেদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। তবে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। ছেলেরা মেয়েদের সৌন্দর্যের পরে দেখে আচার-ব্যবহার। আর মেয়েরা সৃজনশীল ছেলেদের পছন্দ করে।

৩. দূর থেকে দেখে একজনকে ভালো লাগল মানে এই নয় যে তার সঙ্গে আপনার প্রেম হয়ে যাবে। প্রেমের প্রথম শর্ত হলো স্বাভাবিক যোগাযোগ। যাকে ভালো লেগেছে, সে আপনাকে পছন্দ করল কি না, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। এর জন্য তাকে হয়তো একটা বই উপহার দিতে পারেন। বৃষ্টি হলে, আকাশে চাঁদ উঠলে মেসেজ পাঠাতে পারেন। পর পর তিনবার মেসেজ পাঠানোর পরও উত্তর না পেলে ধরে নেবেন, আর কোনো আশা নেই।

৪. পৃথিবীতে প্রতিটা বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। একইভাবে নর-নারীও একে অপরকে আকর্ষণ করে। ফলে কেউ যদি আপনার প্রেমে পড়ে, তাহলে সেটা অবশ্যই বুঝতে পারবেন। আর বুঝতে পারলে তাকে একদিন কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কেউ বা তোমায় ভালোবাসে/ কেউ বা বাসতে পারে না যে,/ কেউ বিকিয়ে আছে,/ কেউ বা সিকি পয়সা ধারে না যে,/ কতকটা যে স্বভাব তাদের/ কতকটা বা তোমারো ভাই,/ কতকটা এ ভবের গতিক-/ সবার তরে নহে সবাই।/ তোমায় কতক ফাঁকি দেবে/ তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,/ তোমার ভোগে কতক পড়বে/ পরের ভোগে থাকবে বাকি,/ মান্ধাতারই আমল থেকে/ চলে আসছে এমনি রকম-/ তোমারি কি এমন ভাগ্য/ বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!/ মনেরে আজ কহ যে,/ ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে।’

স্মার্ট হোন। যাকে পছন্দ করছেন, সে আপনাকে পছন্দ না-ই করতে পারে। তাই বলে সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা জনে জনে বলে বেড়াবেন না। একইভাবে কেউ আপনাকে প্রস্তাব দিলে সেটাও জনসমক্ষে প্রকাশ করা অন্যায়। আপনার নিজের সম্মান যেমন জরুরি, তেমনি অন্যের সম্মানও জরুরি। ভালোবাসা অপরাধ নয়।