ভাষা মতিনের চোখে পৃথিবী দেখেন রেশমা

প্রায় সাড়ে সাত বছর আগে মারা গেছেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। কিন্তু আজও তাঁর দান করে যাওয়া কর্নিয়া দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখছেন স্বাস্থ্যকর্মী রেশমা নাসরিন। ধামরাই গিয়ে রেশমার কাছ থেকে সেই গল্পই শুনে এসেছেন সজীব মিয়া

বাবার চাকরির সুবাদে আমরা তখন ময়মনসিংহ সেনানিবাসে থাকি। দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরতেই মনে হলো বাঁ চোখটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। চোখটা কুটকুট করে ভীষণ চুলকাচ্ছিল। চোখ ডলতে থাকি। চোখটা একসময় লাল টকটকে হয়ে যায়। ময়মনসিংহের একজন চক্ষুচিকিৎসকের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন বাবা। চোখ দেখে চিকিৎসক জানালেন, অ্যালার্জির কারণে এমনটা হয়েছে। কিছু ওষুধের নাম লিখে দিলেন। দুশ্চিন্তা করতে মানা করলেন।

বাসায় ফিরে ওষুধ খেলাম। কিছুক্ষণ পর চোখ খচখচ কমে গেল। কিন্তু পুরোপুরি স্বাভাবিক হলো না। এরপর চুলকানি হলেই চিকিৎসকের পরামর্শে আমাকে ওষুধ খাওয়ানো হতো। এভাবে অনেকটা সময় চলে যায়। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন বাবা। ময়মনসিংহ থেকে আমরা ধামরাইয়ে চলে আসি। ঈশান নগর গ্রামে আমাদের বাড়ি। বাড়ির পাশের স্কুলে ভর্তি হই। নতুন বন্ধু পাই। স্বাভাবিক নিয়মে চলে জীবন। কিন্তু চোখের সেই সমস্যা দূর হয় না।

রেশমা নাসরিন
ছবি: ছুটির দিনে

বাবা আমাকে নিয়ে আজ সাভার যান তো কাল মানিকগঞ্জ। চিকিৎসক দেখান। ঢাকায় গিয়েও কয়েকজন চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেন। কেউ বলেন অ্যালার্জি, কেউ বলেন তেমন কিছু নয়, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, সমস্যাটা গুরুতর। দিন দিন কমছে আমার চোখের আলো। সামান্য দূরের জিনিস দেখতেও কষ্ট হয়। আরও পরে সবকিছু ঝাপসা হতে থাকে। ক্লাসে বসে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা পড়তেও কষ্ট হয়।

২০০৭ সাল। স্নাতকে পড়ি। বাঁ চোখটি প্রায় নষ্টই হয়ে গেল। ডান চোখটি ভালো থাকলেও দূরের কিছু দেখতে অসুবিধা হতো। বন্ধুদের সহায়তায় নোট নিতে হতো। বিষয়টি আমাকে ভীষণ পীড়া দিত।

এর মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে যায়। গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যকর্মীর চাকরিও পাই। সব মিলে দিন কাটতে থাকে।

২০১৩ সালে আমার বাঁ চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। মিরপুরে এক চিকিৎসকের কাছে যাই। প্রথমবারের মতো তিনি বলেন, আমার কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে। দ্রুত চিকিৎসা না করালে অন্য চোখেও প্রভাব পড়তে পারে। তিনি আরও জানান, ভারতে কর্নিয়াপ্রাপ্তিসহ চিকিৎসার সুব্যবস্থা থাকলেও দেশে কর্নিয়া পাওয়া সহজ নয়।

প্রয়াত ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন
ছবি: প্রথম আলো

ভাষাসৈনিকের মৃত্যুসংবাদ

কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য ভারতে যেতে হবে। সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর টেলিভিশন স্ক্রলে এল ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মৃত্যুসংবাদ। জানানো হলো ভাষাসৈনিকের মরণোত্তর দেহ ও চক্ষুদানের বিষয়টিও।

কর্নিয়ার জন্য সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিতে আমরা আগেই নিবন্ধন করে রেখেছিলাম। ভাষা মতিনের চক্ষুদানের বিষয়টি জানার পরই আমরা সন্ধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাদের তারা দ্রুত ঢাকায় আসতে বলে। ঢাকায় আসার পর শুরু হয় অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি।

নিজেকে তখন ভীষণ স্বার্থপর মনে হচ্ছিল। একজন মানুষ প্রয়াত হয়েছেন, যিনি কিনা দেশের প্রথিতযশা একজন মানুষ, ভাষাসৈনিক। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে নিকটজনেরা শোকে মুহ্যমান। ঠিক সেই সময়টায় আমি এসেছি তাঁর দান করা চোখের আশায়। এখন ভাবলে কিছুটা কষ্টও হয়। কিন্তু পরিস্থিতি হয়তো কখনো কখনো মানুষকে এমন স্বার্থপরও করে তোলে।

স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে রেশমা নাসরিন
ছবি: ছুটির দিনে

ভাষা মতিনের চোখে স্বপ্ন দেখি

ভাষা মতিনের মৃত্যুর এক দিন পর আমার চোখে অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচার করেন চক্ষুবিশেষজ্ঞ শীষ রহমান। সে রাতটা দোলাচলের মধ্যে কেটে যায়। আমার পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন, কী হয়, তারই অপেক্ষা।

এক দিন পরই চোখ খুলে দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখি আবছা আলো। ৫ মিনিট, ১০ মিনিট করে ঘণ্টাখানেক কাটে। বাঁ চোখে আলো বাড়তে থাকে। সামনের সবকিছু দেখতে শুরু করি। সে সময়টার আনন্দ শুধু আমিই অনুভব করতে পারি। চোখ যে মানুষের অমূল্য অঙ্গ, এই মর্ম আলো হারিয়ে যেমন বুঝেছিলাম, তেমনি আলো ফিরে পেয়েও বুঝেছি।

আমার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের কত বীরত্বগাথা শুনেছি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমার জ্ঞান সীমিত ছিল। বইয়ের পাতায় যেটুকু পড়েছি, সেটুকুই ছিল সম্বল। তাই ভাষা মতিনের নাম জানলেও তাঁর অবদান সম্পর্কে তখনো বিস্তারিত জানতাম না। সেটুকু জেনেছি তাঁরই দান করা চোখে বই পড়ে।

এখন আমার ভীষণ গর্ব হয়, নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়—আমার শরীরে বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বহমান, আমি পৃথিবী দেখি একজন ভাষাসৈনিকের কর্নিয়ায়।

কবীরও পেয়েছিলেন ভাষা মতিনের কর্নিয়া

ইকবাল কবীর একটি ফোন কলের অপেক্ষায় ছিলেন দীর্ঘদিন। সে কলটা পেলেন ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর। সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির পক্ষ থেকে কল করে তাঁকে জানানো হলো দ্রুত ঢাকায় আসতে।

ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে পরদিনই চলে এলেন এই কলেজশিক্ষক। রেশমা নাসরিনের মতো তাঁরও অস্ত্রোপচার হলো। ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের দান করা আরেকটি কর্নিয়া স্থাপন করা হলো ইকবাল কবীরের চোখে।

তবে অস্ত্রোপচারের বছর দুই পরই কর্নিয়া পরিবর্তন করতে হয়েছিল ইকবাল কবীরকে। তিনি বলছিলেন, ‘কোনো ত্রুটির কারণে আমার চোখে কর্নিয়া সঠিকভাবে কাজ করেনি। পরে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়েছে।’

তবে ভাষা মতিনের মতো একজন মানুষের কর্নিয়া যে তাঁর চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, তাতেই গর্বিত ইকবাল কবীর।