মরীচিকা

মৃগতৃষ্ণিকা নয়। বিজ্ঞানে বিশ্বাসীরা বলতেই পারেন, এটা মরীচিকা বা মিরেজ; আমি তা দেখেছি তার চেয়ে অধিক। যেহেতু বহুমাত্রিক সেই মরীচিকায় আমি নিমজ্জিত ছিলাম। প্রকৃত এক প্রকৃতির মধ্যে ছিলাম প্রায় দুই ঘণ্টা। সঙ্গে কেউ ছিল না বলে অবিশ্বাস্য সেই নিসর্গ ছিল আমার একার।
মরুমধ্যাহ্নে সূর্যই সম্রাট। অবাধ ও অবিরত রোদ লেগে রূপ আর রং খোলে দুপুরের মরুভূমি। কোথাও বালির ঝালর তপ্ত বাতাসে। কোথাও প্রাচীন পাথর জ্বলেপুড়ে কালো হয়ে পড়ে আছে জামানার সাক্ষী হয়ে।
আমি যাচ্ছিলাম জেদ্দা থেকে মদিনার পথে। বাম পাশে লোহিত সাগর। এই আট লেনের সড়ক বানাতে ভাঙতে হয়েছে অনেক পাথর। কাটা পড়েছে কঠিন পাহাড়ও। সেতুর নিচে গিরিখাদ। মহাসড়কের কিনারা ধরে কোথাও ইস্পাতের তারের বেড়া; দুর্ঘটনা থেকে আগলে রাখার প্রয়াস।
তিন রংয়ের বালিয়াড়ি। সাদাটে, ধূসর ও সোনালি। বাতাসের তোড়ে নড়ে বাবলার শাখাপ্রশাখা। দুলে ওঠে বেদুইনের তাঁবু। গাড়ি দ্রুত চলেছে বলে ধেয়ে আসে ধূসর পাহাড়, কালচে পর্বতরেখা। সামনে সড়ক ঢালু হতেই অভাবনীয় এক জলের সরোবর। মনে হয় বন্যাতে কি ডুবে গেল পথ!
ব্রেকে পায়ের চাপে গাড়ির গতি কমে। এটা তো রোদের প্লাবন। ঝিকিমিকি স্বচ্ছ জলের শরীরে আলো কিংবা আলোকিত জল। এটা যেন তরল কাচ বায়ুপ্রবাহের তলে। সেই জলে ডুবে যায় আমার সামনের গাড়িটি। বিপরীত দিকে দেখি একই জলে ডুব দিয়ে উঠে আসে আরও গাড়ি। আমি ছুটে এগিয়ে যাই আর সরোবর সরতে থাকে দূরে।
দিগন্তে ‘জলেভাসা’ পর্বতও কাঁপে। এই মায়া-মরীচিকা আমাকে ঘিরে ধরেছিল চারদিক থেকে। প্রচণ্ড রোদের নিচে উত্তপ্ত পাথরঢালা পথ থেকে তাপের বিকিরণ বাতাসে কাঁপছিল বলে এই খেলা। বেঁকে যাওয়া রশ্মির কারিশমা।

মরুভূমি পাড়ি দেওয়া এই সড়কে আগেও চলেছি আমি অনেকবার। সেসব ছিল রাত্রিকালের যাত্রা। ঠান্ডা অন্ধকারে মরুভূমি শীতল হতে থাকে শিগগির। খুব কালো আকাশজুড়ে তারাদের স্নিগ্ধ সংসার। দূরে ও অদূরে মরুবাসীদের ডেরা থেকে মিটিমিটি হলুদাভ আলো। গাড়ির হেডলাইট থেকে আলোর তীব্র তীর মসৃণ আঁধারে লেগে পিছল খেতে থাকে। অন্ধকার ঠেলে চলতে চলতে যেন বাতাসও শান্ত। মরুরাত্রির এই রূপ লেখার নয়, দেখারই দৃশ্য।
‘অর্থ মরীচিকা’র দেশও সৌদি আরব; লাখো বাঙালি সাড়া দিয়েছে পেট্রো ডলারের হাতছানিতে। তাঁদেরই একজন আসগর আলী। জীবন নিয়ে যাঁর অভিজ্ঞতা এখন ৫৭ বছর।
আট বছর যাওয়া হয়নি দেশে তাঁর। বিদেশে আসার আগে স্বপ্ন ছিল ঢের। মনভর্তি আশা ছিল অনেক। বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিতেই এটা-সেটা ঝামেলা এসে দাঁড়ায়। এই তো ঝড়ঝাপটা গেল ‘কফিল আকামা’ নিয়ে; কড়কড়ে ৯০০০ রিয়াল গুনতে হলো। জেদ্দায় একটি বোরকার দোকানে চাকরি। কত আর মাইনে।
শোনানো হতো, আরব দেশে শুধু যেতে পারলেই হলো। হাত বাড়ালেই টাকাকড়ি, সোনাদানা। যত চাই। তাই তো শেষ সম্বল ৫ শতাংশ জমিটুকু ‘বন্ধক’ রেখে, ছোট্ট মুদির দোকানটা বেঁচে দিয়ে ‘আরব যাত্রার’ তেলপানি জোগাড় হয় আসগর আলীর। নগদ কিছু ঋণও নিতে হয় তাঁকে এদিক সেদিক থেকে।
আসগর আলী বলেন, ‘ভাই লেখবেন আমাদের কথা। আরব কফিলেরা গরিব মজুরের টাকাও খায়, এটা লেখবেন। কফিল ছাড়া আকামা হয় না। আকামা ছাড়া ধরা পড়লে দেশে ফেরত। হুকুমতের হুকুম। জুলুম যতই হোক থাকা তো লাগে। বাঁচতে তো হয়। তবুও ভালা আছি ভাই। হজটা করলাম। খরচ করে মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলাম। ছেলেটা এবার বিএ পাস করবে। বন্ধকী জমিটাও ছাড়াই লইছি।’
এ কথা বলার সময় আসগর আলীর চোখে জলের কাঁপন। সেটা থামলে আবার বলেন, ‘গত আট বছরে দেশে কত আপনজন মারা গেল। বড় বইনটাও চলে গেল। তাঁদের লগে আর কোনো দিনই দেখা হবে না। দেশ থেইকা মওতের খবর, পরবাইস্যা মাইনষের লাই ভাই বড্ড বেদনার।’
জেদ্দা, সৌদি আরব