মহানগর গোধূলী

স্টেশনে ঢুকে ট্রেনের দিকে দৌড়াতে শুরু করলেন আফনান আব্রাম সাহেব। ঘড়িতে ৪টা ১০ বাজে, মহানগর গোধূলী ছাড়তে মাত্র ১০ মিনিট বাকি। ভিড় ঠেলে ট্রেন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন কি না ভেবে অস্থির লাগছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফনান সাহেব। বয়স ষাট ছুঁই-ছুঁই করলেও চোখে লেন্স, চেক শার্ট, জিনস আর স্নিকার পরা লম্বা শুকনা ধরনের আফনানকে দেখে চল্লিশের বেশি মনে হয় না। পিঠে ব্যাগপ্যাক নিয়ে ভিড় ঠেলেই ছোটার চেষ্টা করছেন তিনি। কাল সকালে ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস আছে, তিনি কখনোই নিজের প্রয়োজনে ক্লাস বন্ধ করেন না, কিন্তু আজ মনে হয় ট্রেন মিস হয়ে যাবে, এটা ভাবতেই মেজাজটা বিগড়ে গেল। মনে হলো, এখন সাজিদকে পেলে কষে একটা চড় দিতেন। সাজিদ তাঁর ছাত্র, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ওর ওখানেই একটা পরীক্ষার এক্সটার্নাল হয়ে এসেছিলেন আফনান। কিন্তু রাগটা হচ্ছে অন্য কারণে, ছেলেটা আসার সময় একটা থলেতে ভরে বিরিয়ানির একটা প্যাকেট, পানি আর কিছু ফল হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, বলেছে পথে নাকি ক্ষুধা লাগবে। আচ্ছা, ট্রেনের মধ্যে কি বিরিয়ানি খাওয়া যায়? শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কম্পার্টমেন্টে বিরিয়ানির প্যাকেট খুললে গোটা ঘরটা কেমন বিরিয়ানি বিরিয়ানি গন্ধ হয়ে যাবে? আচ্ছা! এই ছেলেমেয়েগুলো এত গাধা কেন? গাধাটা আবার বলে কি ‘স্যার, আপনি না নিলে আমি খুব কষ্ট পাব’, আরে তুই কি আমার গার্লফ্রেন্ড যে কষ্ট পাবি? সাজিদ আফনানের অনেক প্রিয় ছাত্র, ছেলেটা অল্প বয়সে অনেক ভালো করছে। মনটা এখন সাজিদ থেকে সরিয়ে অন্য কিছুর দিকে নিয়ে যেতে হবে, ওকে নিয়ে আরও ভাবলে মেজাজ আরও খারাপ হবে।

আশপাশে তাকাতেই আফনান দেখলেন বছর তিনেক বয়সের একটা ছেলে, একটা ভাঙা ঝুড়ির ভেতর মাথা ঢোকানোর চেষ্টা করছে, আর কিছুক্ষণ পরপর ঝুড়িটাকে বুকে চেপে ধরে ফিক করে হেসে দিচ্ছে। আফনান কাছে গিয়ে, হাঁটু ভাঁজ করে বসে বললেন, ‘বাবা! আমি যদি তোমাকে কিছু খাবার দিই, তুমি নেবে?’ ছেলেটা হাত বাড়িয়ে খাবারের থলেটা নিল, তারপর স্যালুট দেওয়ার মতো ভঙ্গি করল। আফনানের মনে হলো বাচ্চাটার কাছে কিছুক্ষণ বসতে পারলে হতো, কিন্তু ট্রেন ছাড়তে আর বাকি তিন মিনিট। আজকাল বাংলাদেশের ট্রেন সব অনটাইম। হঠাৎ একদিন সব ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়তে শুরু করল, কিছু কিছু জিনিস এই দেশে হুট করেই হয়। আফনান এবার উঠলেন, কম্পার্টমেন্টের কাছে আসতেই আটকে গেল পা। হালকা নীল বর্ণের সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটা ট্রেনের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে ভারী চশমা, হাতে বেশ কিছু বই, লম্বা চুল বাতাসে উড়ছে। হাতে থাকা পানির বোতল থেকে পানি খাচ্ছিল মেয়েটা, মুখে পানি নিয়েই আফনানের দিকে তাকাল। মেয়েটাকে আফনান চেনেন—তার নাম অগ্নি! ০৪ ব্যাচ, বিভাগের প্রথম ব্যাচ ওরা। তা ছাড়া আফনানের শিক্ষকতা-জীবনেরও প্রথম ব্যাচ। তাই ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই সম্পর্ক ছিল। অগ্নি মাস্টার্সে প্রথম হয়েছিল। আফনান তাঁর একজীবনে অগ্নির চেয়ে সুন্দর কাউকে দেখেননি। এই রাগী রাগী মেয়েটার সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলার একটা অদ্ভুত গুণ ছিল। কিন্তু এই সবকিছুর বাইরেও অগ্নিকে মনে রাখার আরও হাজারটা কারণ আছে আফনানের। একটা কারণ এটা হতে পারে, প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন অগ্নিকে। অন্য একটা কারণ, তিনি এখনো অগ্নিকে ভালোবাসেন।

রেজাল্টের পর যেদিন অগ্নি চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, খুব কাঁদছিল মেয়েটা। আফনান স্টেশনে এসেছিলেন সেদিন। ওই দিনই প্রথম ওকে আলাদা করে একা দেখা হয়েছিল। আফনান অগ্নির মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো।’ আর একটা চিঠি দিয়েছিলেন। ‘আমার পেশা আমাকে, তোমাকে চাওয়ার স্বাধীনতা দেয়নি, তবে ভালোবাসার স্বাধীনতা আছে। সব ভালোবাসায় যে কাছে থাকার আকাঙ্ক্ষা থাকবে, এমন তো নয়। আমাদের ভালোবাসা না হয় শুধু ভালো চাওয়ায়।’

তারপর আর দেখা হয়নি ওদের। আজ ছয় বছর পর দেখা।

‘অগ্নি, কেমন আছ? দেশে এসেছ কবে?’

‘গত মাসে এসেছি, স্যার। কেমন আছেন আপনি?’

‘এই তো ভালো, কোথায় যাবে এখন? গোধূলীতেই টিকিট তোমার?’

‘আমি সিরাজগঞ্জ যাব।’

‘তুমি আসলে কোথাও যাচ্ছ না, তাই না?’

অগ্নি মাটির দিকে তাকায়। একমুহূর্ত চুপ থেকে বলে উঠল, ‘স্যার, আপনার ট্রেন ছেড়ে দেবে, উঠে পড়েন।’

আফনান অগ্নির মাথায় হাত রেখে আবার বললেন, ‘ভালো থেকো, গেলাম।’ ট্রেনে পা দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

আফনানের বুকের ব্যথাটা শুরু হয়েছে। অগ্নি ওঁর ছাত্রী, ওঁর থেকে বয়সে অনেক ছোট, তাই ওর সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন আফনান কোনো দিন দেখেননি। ভেবেছিলেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নি ওঁকে ভুলে যাবে, নিজের জীবন নিজের মতো গুছিয়ে নেবে। কিন্তু আজ অগ্নির চোখ অন্য কথা বলেছে। এই ৩৫ সেকেন্ডের স্মৃতি নিয়ে ওরা আবার একটা দীর্ঘ একা জীবনের পথে ফিরে যাচ্ছে।

ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড