এই অভিনেতার মাদক ছাড়ার গল্পটাও সিনেমার মতোই

টালিগঞ্জের (কলকাতা) এ সময়ের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমা, ধারাবাহিক ও ওয়েব সিরিজে কাজ করছেন। অথচ কয়েক বছর আগেও তাঁর জীবন ছিল অন্য রকম। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতেন রাস্তায়, রেলস্টেশনে, নয়তো পার্কে। মা–বাবা তাঁর পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন, সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারতেন না। পুলিশের জিম্মায় কেটেছে অনেক রাত। সেই অনিন্দ্যই ঘুরে দাঁড়ান ২০০৮ সালে। নিজেকে মাদকমুক্ত করে ফিরে আসেন দারুণভাবে। পরবর্তী সময় কলকাতা পুলিশের সঙ্গে শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও কাজ করেছেন। মাদকের তাঁর লড়াইয়ের গল্প লিখেছেন ফেসবুকে। প্রথম আলোতে তা প্রকাশের অনুমতিও দিয়েছেন তিনি। আজ আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসে তাঁর সেই পোস্টের খানিকটা সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশিত হলো

অভিনেতা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ছবি: অনিন্দ্যর ফেসবুক পেজ থেকে

আমার কাছে এখনো জলের মতো স্পষ্ট ২০০৮ সালে সেই দিনটা। ব্যাঙ্কসাল আদালতে হাজিরা দিয়ে আমাকে রিহ্যাবে (মাদক নিরাময় কেন্দ্র) ফিরতেই হতো। নয়টার বনগাঁ লোকাল আর সঙ্গে ছিল শেষবারের মতো নেশা করব বলে একটু ব্রাউন সুগার, পাতি বাংলায় কয়েকটা পাতা আর একটা সিরিঞ্জ, একটু তুলা।

নেশা থেকে বাঁচতে অনেক বছর রিহ্যাবে রিহ্যাবে ঘুরেছেন
ছবি: অনিন্দ্যর ফেসবুক পেজ থেকে

হাবড়া (হাওড়া) স্টেশনে নেমে একটু এগোলেই সেই রিহ্যাব, যেখান থেকে আমার ভালো থাকার লড়াই শুরু হয়েছিল। তার আগে প্রায় ২৮ বা ২৯টা ডিটক্স আর রিহ্যাব হয়ে গেছে। যেদিন ছাড়া পেতাম, সেদিনই রিল্যাপস (পুনরায় মাদকাসক্ত), এ রকম একটা প্যাটার্ন ছিল। ৬–৭ বছর ধরে অনবরত ঘুরতে থাকা একটা বৃত্ত। হয় বাইরে নেশা করছি, নয়তো তালা–চাবির ভেতরে ভালো আছি। তালা–চাবির বাইরে বেরোলেই আবার নেশা। না নিজে বিশ্বাস করতাম যে আমি কোনো দিন ভালো হতে পারব, না আমাকে কেউ বিশ্বাস করত যে আমি কোনো দিন নেশা ছেড়ে দেব। উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের আর কতই বা ক্ষমতা?

বাড়ির সবকিছুই মোটামুটি তত দিনে প্রায় শেষ। সে মায়ের সোনার গয়না হোক বা বাবার সঞ্চয়। এরপর বাইরের লটরবহর তো আছেই। লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, কাঁসার জিনিস তখন আমার কাছে সোনার মতোই দামি। যেকোনো গাড়ির লক খুলতে লাগত ঠিক তিন মিনিট। একটা নোকিয়ার মুঠোফোন মানে ক্যাশ দুই–তিন হাজার। সেটাই অনেক তখন আমার কাছে।

সুস্থ থাকতে নিয়মিত সাইকেল চালান এই অভিনেতা
ছবি: অনিন্দ্যর ফেসবুক পেজ থেকে

এ রকম একটা সময় আমি আমি বুঝতে পারছিলাম, এভাবে যদি চলতে থাকে, আমি ২৮ বছর অবধিও টানতে পারব না। আর চোখের সামনে চার মাদকাসক্ত সঙ্গীকে পরপর মারা যেতে দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলাম। এতটাই বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলাম যে আমার সেই রিহ্যাবে যাওয়া আর সেখানে আবার কয়েক মাস চার দেয়ালের মধ্যে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। যদি থাকত, তাহলে আরও কয়েক দিন টানতে পারতাম। কিন্তু পারিনি। আর এই উপলব্ধিটাই আমাকে একটু হলেও সাহস জুগিয়েছিল। এভাবেই আমার ভালো থাকার শুরু।

শুরুটা সত্যি কঠিন ছিল। না কেউ বিশ্বাস করত, না নিজে বিশ্বাস করতাম যে নেশা করা ছেড়ে দেব। জীবনের ধ্যানজ্ঞান ভালোবাসা তো ছিল একটাই—নেশা। ওটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম আর নেশা আমাকে মারতে চেয়েছিল।

নিজেকে মাদক থেকে দূরে রাখতে এখন আছে তাঁর মনের জোর
ছবি: অনিন্দ্যর ফেসবুক পেজ থেকে

আজ যখন রাস্তায় লোকে সেলফি তুলতে চায়, অটোগ্রাফ চায়, ভালোবাসা দেয়, তখন আমি নিজেকে দেখি আর পুরোটাই কেমন স্বপ্নের মতো লাগে। এটা সত্যি হচ্ছে তো? কোথায় সেই ছেলেটা আর কোথায় আজকের আমি!

চোখের সামনে চার মাদকাসক্ত সঙ্গীকে মারা যেতে দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলেন
ছবি: অনিন্দ্যর ফেসবুক পেজ থেকে

হয়তো আরও কিছু করতে পারতাম। হয়তো আরও একটু জীবনটা গোছাতে পারতাম। পারিনি, কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনো খারাপ লাগা নেই। যা আছে, যেটুকু সম্মান আর ভালোবাসা আমাকে সমাজ ফিরিয়ে দিয়েছে, আমি সেটা নিয়েই খুশি। বাকিরা এগোক না, ক্ষতি কী!

আমার শুরু তো অনেক নিচ থেকে আর আমার লড়াইটাও একটু হলেও আলাদা, একটু হলেও কঠিন। আমার লড়াই সেই বাঁদরটার সঙ্গে, যে আজও আমার মধ্যে আছে। যাকে আমাকে প্রতিনিয়ত বশে রাখতে হয়। তার জন্য যদি দামি গাড়ি–বাড়ির একটু দেরি হয়, হবে। না হলেও আমার কোনো আপত্তি নেই। মা চলে যাওয়ার আগে আমাকে নেশামুক্ত দেখে গেছে, কিন্ত বাবা চলে যাওয়ার আগে আমার ঘুরে দাঁড়ানো প্রত্যক্ষ করে গেছে। গর্ব করে সবাইকে বলত, আমি অনিন্দ্যর বাবা। বোনেরও গর্ব আমি। আর কী চাই?

১৪ বছর মাদক থেকে পুরোপুরি আলাদা আছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
ছবি: অনিন্দ্যর ফেসবুক পেজ থেকে

এভাবেই একেকটা দিনের লড়াই আমার চলতে থাকুক। অভিনেতা বা সেলিব্রিটি অনিন্দ্য চাটার্জি তো আমি ফেসবুকে, শুটের লোকেশনে বা বাড়ির বাইরে বেরোলে। বাড়িতে আয়নার সামনে এখনো আমি সেই বাঁদর ছেলেটাই। ওকে দমিয়ে রাখতে পারলেই আমি বাকিটা সামলে নেব। আমার উপলব্ধ ঈশ্বর আমাকে এভাবেই আমাকে আগলে রাখুক। আর ভালো থাকুক পৃথিবী। আমার কাছের মানুষগুলো। আমার বন্ধুরা। এটাই প্রার্থনা।