মারুফার জীবনটা রূপকথা

রূপকথার গল্পের মতোই মারুফার জীবন। ফুটপাতের দোকানি বাবার কাছে কেটেছে শৈশব। স্বপ্ন ছিল কারাতে শিখবেন, কিন্তু টানাটানির সংসারে ভর্তি ফির ৩০০ টাকা জোগাতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল। সেই মারুফার বাড়িতেই এখন শোভা পাচ্ছে কারাতে, জুডো, উশু, কুস্তি করে ছিনিয়ে আনা ১৫টি স্বর্ণপদক। রয়েছে দুটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পদক।

কারাতে প্রশিক্ষক মারুফা খাতুন
ছবি: শহীদুল ইসলাম

মারুফার বয়স এখন ২৯ বছর। শৈশবের কথা তুলতেই বললেন, ‘কারাতে কোর্সে ভর্তির তিন-চার মাস পরই একটি টুর্নামেন্ট ছিল। আমাকে অংশ নিতে হবে জেনে খুব ভয় হচ্ছিল, যদি ব্যথা পাই।’ সেই টুর্নামেন্টে আহত হননি মারুফা। ভয়ও কিছুটা কেটে গেল। পরের বছর ২০০৫ সালে আরেকটি টুর্নামেন্ট ছিল। মারুফা বলে যান, ‘তখন আমার ওজন ৩৬ কেজি। অন্য প্রতিযোগীরা ছিল ৮০ থেকে ৯০ কেজি ওজনের। ছেলেরাও ছিল। সবার সঙ্গে লড়াই করে জিতে যাই।’

সেই শুরু হলো মারুফার জয়যাত্রা। রাজশাহী স্টেডিয়ামে আন্তজেলা টুর্নামেন্টে স্বর্ণপদক পেয়ে গেলেন। দুই বছরের মধ্যে ২০০৭ সালে জুডোতে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক পেলেন। নির্বাচিত হলেন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ও। খেলায় এত সাফল্যের পরও পড়াশোনা ছাড়েননি মারুফা। অন্যদের মতো প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য ছিল না। ছিল না স্কুল ড্রেসও। প্রায়ই এ জন্য শিক্ষকের বকাও খেতে হয়েছে। আর স্কুলে গিয়ে টিফিনে খাওয়া তো ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও মারুফা ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার মধ্যেও কারাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এ খেলাতেও স্বর্ণপদক পান। সে বছরই ভারতে জুডো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে রৌপ্যপদক পান মারুফা। ভালো খেলার সুবাদে ২০১০ সালে আনসার বাহিনীতে চাকরির সুযোগ পান মারুফা। একই বছর সরকারি খরচে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান থাইল্যান্ডে। এই আনন্দের মধ্যেও মারুফার জীবনে নেমে আসে হাহাকার। সেই কথা বলতে গিয়ে মারুফার চোখ ভিজে ওঠে, ‘প্রশিক্ষণ শেষে বিমানবন্দরে নেমেই আনন্দের খবরটি বাবাকে দিতে চেয়েছিলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। ব্যাকও করলেন না। পরে জানতে পারি, আবার বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন বাবা। সব আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেল।’

গোড়া থেকে আবার সব শুরু করতে হলো। কারণ, সংসারে রোজগারের দ্বিতীয় কেউ নেই। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর স্থানীয় একটি কলেজে স্নাতকে ভর্তি হলেন। স্নাতকে পড়ার সময়ই ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে জুডোতে স্বর্ণপদক পেলেন। ওই বছরই যেন তাঁর জন্য স্বর্ণবছর! মোট পাঁচটি সোনা জিতেছিলেন সেবার। সব মিলিয়ে তাঁর ঝুলিতে এখন ১৫টি স্বর্ণপদক। একই বছর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মারুফা। পাশাপাশি অব্যাহত থাকে তাঁর পড়াশোনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করেছেন। ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ। গত বছর ভারতের পাঞ্জাবের নেতাজি সুভাষ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস থেকে সাফল্যের সঙ্গে স্পোর্টস কোচিং ইন ডিপ্লোমা (জুডো) করেছেন মারুফা খাতুন। এখন রাজশাহী শারীরিক শিক্ষা কলেজে বিপিএড ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছেন।

মারুফা এখন রাজশাহী শারীরিক শিক্ষা কলেজে বিপিএড ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছেন
ছবি: শহীদুল ইসলাম

রাজশাহী নগরের পদ্মা আবাসিক এলাকায় মারুফার বাড়ি। সেখানেই গড়ে তুলেছেন বেঙ্গল মার্শাল আর্ট একাডেমি। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত, আর শনি সোম বুধ ও শুক্রবার বেলা তিনটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা এই একাডেমিতে মারুফার কাছে শরীরচর্চার তালিম নেয়। মারুফার দুই মেয়ে। বড়টার বয়স ছয় বছর আর ছোটটার তিন। ছোট মেয়েটা ইতিমধ্যে দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারুর স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বামী দস্তগীর আবদুল্লাহও মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট ফোর্থ ড্যান (এইচএসকেএ)। মারুফার ভাষায়, তাঁর স্বামী খুব ভালো মনের মানুষ। তাঁর সহযোগিতার কারণেই দুটি সন্তান হওয়ার পরও তিনি নিয়মিত অনুশীলন করতে পারছেন। সেই সঙ্গে পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে পেরেছেন।

ওস্তাদ আহসান কবির ও ওয়াসিম আলীর কথা কোনো দিন ভুলবেন না মারুফা। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া কারাতে কোর্সে ভর্তিই হতে পারতেন না। তবে এখন একটা চাকরির তাঁর বড় প্রয়োজন। শুধু শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিয়ে সন্তানসন্ততি নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।