মায়ের শাড়ি কাটা হাফশার্ট

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

আমার স্কুলজীবনে ঈদ এলে ভেতরে-ভেতরে ভয় হতো। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতোই বটে। আনন্দের বদলে ভয় কেন? কারণ আছে। ঈদের আগেই আমি কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় পড়ি। অবশ্য প্রতিবার নয়। টানা কয়েক বছর এমনটা হয়েছে। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৯৬ সালের কথা। কোরবানির ঈদের একটা বড় আকর্ষণ ছিল গরুর হাটে যাওয়া। বাসা থেকে গরুর হাট কাছাকাছি ছিল। প্রতিদিন নিয়ম করে একবার যেতাম। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে, কখনো একা।

হাটের বড় গরু দেখে বেড়ানো শখ ছিল। কোনটার চেয়ে কোনটা বড়। একেকটা গরু আমার চেয়েও উঁচু। ঘাড় তুলে দেখতে হয়। রঙিন মালা পরানো। ব্যাপারী একটু পরপর গরুর গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। গলায়, কপালে চুমু খাচ্ছেন। ধলা, কালা—গরুর কত নাম! নাম ধরে ডাকতেই গরুটা ব্যাপারীর শরীরে মাথা ঠুকে আদর খুঁজছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যেত এসব দেখতে দেখতে। গরুর লেজে ধরে টান মারার দুষ্টু একটি খেলা আমার প্রিয় ছিল। পাকা খেলোয়াড়। সুযোগ পেলেই এ কাজ করতাম। এই খেলা খেলতে গিয়ে কতবার যে গরুর লাথি থেকে বেঁচে গেছি, হিসাব রাখিনি।

একবার খুব বৃষ্টি হলো। মাখামাখি অবস্থা। গরুর গোবর আর কাদামাটিতে পুরো হাট একাকার। কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। জুতো দেবে যাচ্ছে কাদায়। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বিকেলে গরুর হাটে গেলাম। কিছু দূর যেতেই দেখি একদল লোক দৌড়ে আসছে। হইচই হচ্ছে। আমি কাদার মধ্যে গেড়ে দাঁড়িয়ে আছি। কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই একটা কালো ষাঁড় হাওয়ার বেগে আমার দিকে ছুটে এল। আমি পথ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও রেহাই পেলাম না। মনে হলো আচমকা কেউ একজন আমার মাথার পেছন দিকটায় বাঁশের লাঠি দিয়ে বাড়ি মারল। আমি উপুড় হয়ে কাদায় পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখ মেলতে পারছিলাম না। লোকজন আমাকে ধরাধরি করে তুলে মাথায় পানি দিল। কিছুটা সংবিৎ ফিরে পাওয়ার পর কয়েকজনকে বলতে শুনলাম, বাঁশের খুঁটি তুলে নিয়েই ষাঁড় ছুটে গেছে। দড়ির একপাশে বাঁধা খুঁটিটা উড়ে এসে আমার মাথায় লেগেছে। সেই ব্যথায় টানা ১০ দিন বিছানায় জ্বর নিয়ে পড়ে রইলাম। ঈদের দিনেও জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। ঘরের পাশে জানালা খোলা ছিল। বাইরে ছেলেমেয়েদের হুল্লা। বিছানায় হাঁটু গেড়ে জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম।

এর পরের বছরের ঘটনা। ঈদুল ফিতরের চাঁদরাত। পাড়ার বন্ধুরা মিলে পটকা, তারাবাজি, মরিচবোমা ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। পথে কোনো অন্ধকার জায়গা পেলেই পটকা মারছি। বিকট শব্দে পথের সবাই আঁতকে উঠছে। যারা পটকায় আগুন দেওয়ার সময় দেখে ফেলেছে, তারা দূরে সরে কানে দুহাত চেপে ধরছে। অনেক বয়স্ক মানুষ গালাগালও দিচ্ছিলেন। আমাদের ওসবে কান দেওয়ার সময় নেই। সবাই আঁতকে উঠছে, এদিক সেদিক ছুটছে এসব দেখে মজা পাচ্ছিলাম। অন্ধকারে পটকাবাজি খেলতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। পটকায় আগুন দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে সোজা এসে ধাক্কা খেলাম স্বাধীন মামার সঙ্গে। স্বাধীন মামা ছিলেন সাদাসিধে একজন মানুষ। লোকে তাঁকে স্বাধীন পাগলা বলত। মামা সব সময় বাংলা সিনেমার গান ঘ-ঘ করে গাইতে গাইতে পথ চলতেন। তাঁর গলার কাছে মাইক ফেল। মামা সেদিন জানালার কাচ বগলদাবা করে যাচ্ছিলেন। ধাক্কা খেয়ে সেই কাচের কোনা গিয়ে বিঁধল আমার কপালের ডান পাশে। ব্যস। ফিনকি দিয়ে রক্ত। মুহূর্তে শার্ট ভিজে গেল। ঈদের আগের রাতে কপালে দেওয়া হলো চার সেলাই। এটাই বোধ হয় লেখা ছিল ভাগ্যে! আমার এ অবস্থায় বাসার সবার ঈদ আনন্দ মাটি হয়ে গেল। কেউ নতুন জামা পরল না। আমার ছোট দুই ভাইবোন সারা দিন আমার পাশে বসে রইল। কোথাও গেল না। ঈদের বাড়ি না শোকের বাড়ি কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। বাসায় মিষ্টান্ন রান্না হলো পরদিন। আমি বিছানা থেকে মাথা তুলে বসেছি। সেই খুশিতে মা সেমাই রান্না করলেন। কিন্তু সে বছর আর কেউ নতুন জামা পরেনি।

তারও বছর দু–এক পরে এক ঈদে নতুন কাপড় কিনে দেওয়ার মতো অবস্থা বাবার ছিল না। মা দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। তার চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাবা হিমশিম খাচ্ছিলেন। ওই বছরটায় সংসারে বেশ অভাব-অনটন লেগেছিল। একহাঁটু ঋণকর্জ নিয়ে বাবা বেশ বিপাকে। ঈদের নতুন জামা কেনা তো দূরে থাক এক কেজি গরুর মাংস কেনার টাকাও ধার করতে হয়েছিল। ঈদের দুদিন আগে মা বিছানা থেকে উঠে আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে বাবার হাতে দিলেন। লালের মধ্যে সোনালি ফুল তোলা কাতান। মাকে দু-একবার শাড়িটা পরতে দেখেছি। এর বেশি না। শাড়িটা মায়ের বেশ প্রিয় ছিল। বেশি পরে নষ্ট করতে চাননি। কিন্তু সেদিন বাবার হাতে শাড়িটা তুলে দিয়ে মা বললেন, দরজির কাছে গিয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের মাপে দুটো হাফ হাতা শার্ট বানিয়ে দিতে। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। সংসারের অভাব-অনটন সবই বুঝি। সেবার মায়ের শাড়ি কেটে বানানো শার্ট পরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু একবারও মনে হয়নি, আমাদের খুশি করতে গিয়ে মায়ের প্রিয় শাড়িটা আর রইল না। এখন ঈদ এলে সেদিনের কথা মনে পড়ে। চোখ ভিজে ওঠে। ভেজা চোখে ম্লান হয়ে যায় চকচকে ঈদের চাঁদ।