মিনারে মুগ্ধতা!

মিনার রহমান
মিনার রহমান

১৬ অক্টোবর ২০১৫। রাজধানীর সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ। ‘কিশোর আলো’ ম্যাগাজিনের প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। বিকেলে ছিল গান। মঞ্চের সামনে হাজার দুয়েক কিশোর-কিশোরী আর তাদের অভিভাবক। শিল্পীর নাম ঘোষণা হলো। মিনার রহমান। নাম শুনেই সবার সে কী চিৎকার! মঞ্চে এলেন মিনার। গিটারে টুং টাং। আর তা শুনেই সবাই বুঝে গেছেন, কোন গানটি করছেন মিনার। আবারও হাততালি। মিনারের কণ্ঠে শুধু ‘তুমি’ শব্দটি উচ্চারিত হলো। এরপর মঞ্চের সামনে ছোট-বড় সবাই একসঙ্গে গাওয়া শুরু করলেন—
‘তুমি চাইলে বৃষ্টি
মেঘও ছিল রাজি
অপেক্ষা শুধুই বর্ষণের
মাতাল হাওয়া বইছে
...।’
গানটির শিরোনাম ‘সাদা’। পুরো গানটি আর গাইতে হয়নি মিনারকে। এরপর দ্বিতীয় গান। মিনার গাইলেন ‘আমি’। সে কী! এবারও সেই একই ঘটনা! সবাই একসঙ্গে গাইলেন-
‘আমি কি দেখেছি হায়
একলা পথে দাঁড়িয়ে
সে ছিল দূরে দূরে তাকিয়ে
আহারে আহারে
কোথায় পাব তাহারে
যে ছিল মনের গহিন কোণে।
গানের শিরোনাম ‘আহারে’। এই গানটিও একা গাইতে হয়নি মিনারকে।
এমনিভাবে মিনার গাইলেন ‘অপেক্ষা’, ‘লিলুয়া বাতাস’, ‘আরও একটু দূরে’, ‘চা খাব না’ গানগুলো। সব কটি গানই লিখেছেন ও সুর করেছেন শিল্পী নিজেই। মিনারের লেখালেখির শুরুটা ছোটবেলায়। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। প্রথম কী লিখেছিলেন? মিনার বললেন, ‘কী লিখেছি, তা এখন মনে নেই। হবে হয়তো কোনো ছড়া, না না গান লিখেছিলাম।’
মিনারের প্রথম অ্যালবাম ডানপিটে (২০০৮)। তিনি এই অ্যালবামের সব কটি গান লিখেছেন, সুর করেছেন ওই সময়। পাশাপাশি কণ্ঠও দিয়েছেন। মিনারের ভাষায়, ‘তখন নাইন-টেনে পড়ি।’ এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই বের করেন ডানপিটে। প্রথম অ্যালবামের কয়েকটি গান দারুণ জনপ্রিয় হয়। ফেসবুকের মাধ্যমে পাওয়া শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়াও ছিল খুবই ইতিবাচক। অন্য রকম কথা আর ভিন্ন সুর; যেমনটা চারদিকে শোনা যায়, তেমনটা নয়। এ কারণেই মিনারের নাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সব বয়সী শ্রোতাদের মাঝে।
ওই বছর মিনার মঞ্চে প্রথম গান করেন। চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে। মিনার বললেন, ‘তা ছিল অ্যালবাম বের হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই। রমরমা অবস্থা। ওই বছর আমি এসএসসি পাস করেছি। পরের অনুষ্ঠানটি ছিল বসুন্ধরা কনভেনশন হলে। গ্রামীণফোনের জিপি নাইট অনুষ্ঠানে সেদিন আমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন পাঁচ হাজার দর্শক। সেদিন দুটি গান করেছি, “সাদা” আর “জানি”। বুঝতে পারলাম, আমার গান সবার পছন্দ হয়েছে।’
মিনার কোন বয়সী শ্রোতাদের জন্য গান করছেন? বললেন, ‘আলাদা করে কোনো বয়সের শ্রোতাদের জন্য নয়। “সাদা” গানটি তো একদম ছোটরা পছন্দ করে, আবার বড়রাও।’
শ্রোতাদের পছন্দের ব্যাপারটি মিনার নাকি গান তৈরির সময়ই বুঝতে পারেন। বললেন, ‘কাজ করার সময়ই তা বেশ অনুমান করতে পারি। এখন যেমন করছি “ঝুম”। দেখবেন, এই গানটিও খুব জনপ্রিয় হবে।’
সবাই যেভাবে হারমোনিয়াম কিংবা তানপুরা নিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে ‘সা রে গা মা’ স্বর সাধনা করে, প্রতিদিন চর্চা করে, মিনারের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। মিনার বললেন, ‘প্রতিদিন দেশি-বিদেশি প্রচুর গান শোনা হতো। এখনো শুনছি। আমার গানে বিশ্ব সংগীত দারুণ প্রভাব ফেলেছে।’
আট বছরে তিনটি অ্যালবাম বের করেছেন মিনার—ডানপিটে (২০০৮), আড়ি (২০১১) আর আহারে (২০১৫)। চতুর্থটি এখনই অ্যালবাম আকারে নয়। একটা একটা করে গান তৈরি হচ্ছে। আর শুরুতে তা ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে তৈরি করবেন মিউজিক ভিডিও।
গোড়াতে গান নয়, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম কার্টুন আঁকেন মিনার। বাসায় বড়রা ছবি আঁকার চর্চা করেন। মিনার বললেন, ‘ছোট থেকে আমি প্রচুর কমিক বই পড়তাম। কমিকের সেই গাট্টি এখনো আছে। আমার কাজে টিনটিন বিশাল অনুপ্রেরণা। এ ছাড়া অ্যাস্টেরিক্স, নন্টে ফন্টে, ব্যাটম্যান, ফ্যান্টম, হি-ম্যান কমিকসগুলো একনিশ্বাসে পড়ে ফেলতাম। এভাবেই কখন যেন কার্টুনের দিকে ঝুঁকে পড়ি।’
পড়ার ব্যাপারেও দারুণ আগ্রহ মিনারের। বললেন, ‘তৃতীয় শ্রেণিতে থাকার সময় প্রথম উপন্যাস পড়েছি। সেটা ছিল সত্যজিৎ রায়ের শুঙ্কু সমগ্র। জন্মদিনে মেজো দুলাভাই (ইকবাল আহমেদ খান) উপহার দিয়েছিলেন। দেড় সপ্তাহে পুরো বইটি শেষ করেছিলাম। মেজো দুলাভাই আর বড় দুলাভাই (নুরুল আফসার মজুমদার) আমাকে প্রচুর বই উপহার দিয়েছেন। বাসায়ও অসংখ্য বই ছিল। এসব বই আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।’
আরও বললেন, ‘বই পড়তে পড়তে গান লেখা শুরু হয়ে যায়। আলাদা করে কখনো গান শেখা হয়নি। আমার একটা কি-বোর্ড ছিল। আম্মু উপহার দিয়েছিলেন। ওটা দিয়েই সুর করার চর্চা শুরু।’
পাঁচ বোনের এক ভাই মিনার। তাঁর কাছে সবার অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু মিনার কী বলেন? ‘গানকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারটা বাসার কেউ তেমন মেনে নিতে পারত না। তবে এখন চিত্রটা বদলেছে। তাদের সেই বিশ্বাস আমাকে অর্জন করতে হয়েছে।’
কার্টুনিস্ট হিসেবে মিনার ২০০৭ সাল থেকে কাজ করছেন উন্মাদ ম্যাগাজিনে। প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘রস+আলো’তেও কাজ করেছেন। ২০১৩ সালের বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথম বই প্রকাশ করেন মিনার। নাম গাবলু। মিনার বলেন, ‘ওটা ছিল কমিকস। গাবলু চরিত্র নিয়ে আরও কমিকস বের করব। অনেকগুলো গল্প তৈরি করেছি।’
বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মিনার। সেখানে ক্রিয়েটিভ বিভাগে কাজ করছেন। চলচ্চিত্রেও গান করছেন। রেদওয়ান রনির আইসক্রিম ছবিতে ‘পথ’ গানটি তাঁর গাওয়া। পাশাপাশি করছেন নাটকের নেপথ্য সংগীত।
এআইইউবি (আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ) থেকে গণমাধ্যমে স্নাতক করেছেন মিনার। আগামী দিনগুলো নিয়ে কী ভাবছেন? মিনার বললেন, ‘এখনো বলতে পারছি না। যেভাবে চলছে, সেভাবেই যাক না।’ এরপর কিছুক্ষণ চুপ। কী যেন ভাবলেন। বললেন, ‘আমার একটা গান মানে শুধু একটা গান নয়, অনেক প্রত্যাশা।
সেই প্রত্যাশাকে তো আর হেলাফেলা করা যায় না। অনেক ভেবেচিন্তে তবেই একটা গান তৈরি করছি। আগামী দিনগুলো গান আর কার্টুন নিয়েই থাকব।’