মুক্তবিহঙ্গ একজন অপি

নুসরাত জাহান অপি ফ্লাই ফার লেডিসের প্রতিষ্ঠাতা

বহু ক্রোশ দূরে, বহু দেশ ঘুরে নারী পর্বতমালা কিংবা সিন্ধু দেখতে চান না। ঘর থেকে দুই পা ফেলে খোঁজ করেন শিশিরবিন্দুটুকুরই। সেই শিশিরবিন্দুর দেখা কী সব সময় নারী পান নিজের মতো করে? কেউ পান। কেউবা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখেন বুকের বাঁ পাশে। ভ্রমণপিয়াসু নারীর জন্য কখন পরিবারের সবার ছুটি হবে, সবার রুটিন মিলিয়ে তারপর ঘর থেকে বের হওয়া। সঙ্গী ছাড়া যেহেতু একা নারীর ভ্রমণ বাংলাদেশে এখনো স্বাভাবিক না, তাই ভ্রমণের জন্য চাতকপাখির মতো প্রতীক্ষা করতে হয় নারীকে। সেই প্রতীক্ষার কিছুটা অবসান ঘটিয়েছে ফ্লাই ফার লেডিস। প্রতিষ্ঠানটি ভ্রমণপিয়াসু নারীর পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশে এবং দেশের বাইরে একা নারী ফ্লাই ফার লেডিসের মাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে পারছেন।

কথা হয় ফ্লাই ফার লেডিসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নুসরাত জাহানের সঙ্গে। কেন তাঁর মনে হলো যে নারীর এমন একটা গ্রুপ, ভ্রমণ প্রতিষ্ঠান দরকার। ‘সালটা ২০১৮। নেপাল যেতে খুব ইচ্ছে করছিল। সেই সময় আমার পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কাউকে পাচ্ছিলাম না আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। টাকাপয়সা, ছুটি সবকিছু গোছানো থাকলেও, সেবার আমি নেপালে যেতে পারিনি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শুধু একজন সঙ্গীর অভাবে আমি নেপালে যেতে পারিনি। তখন আমার মনে হলো, যেহেতু আমরা মেয়েরা একা বের হতে পারি না, তাই আমরা একটা বেড়ানোর গ্রুপ করতে পারি।’ সেই ভাবনা থেকেই নুসরাত জাহানের পথচলা শুরু।

ফ্লাই ফর লেডিসের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভ্রমণ শুরু করে নুহাশপল্লি দিয়ে। সেই ভ্রমণে সঙ্গী ছিলেন সাতজন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশের সব কটি পর্যটনকেন্দ্রসহ নিয়মিত দেশের বাইরে—নেপাল, ভুটান, ভারত ও চীনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমাদের দেশের নারীরা এত অবরুদ্ধ, তাঁরা নিজেদের রিক্রিয়েশনের কথা ভাবার সময়ই পান না। আর যাঁরা পান, তাঁদের সমাজে স্বার্থপর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই শিকল পেরিয়ে এখন কিন্তু আস্তে আস্তে নারীরা তাঁদের নিজেকে বিনোদিত করতে পারছেন। আমি আমার গ্রুপে তরুণী থেকে শুরু করে প্রবীণদের নিয়ে ভ্রমণ করেছি। নিজেরা নিজেরা ঘুরতে গিয়ে তাঁরা এত খুশি! কেউ কেউ আবেগাপ্লুত হয়ে যান। জীবনে এটুকুর মধ্যেই যে এত সুখ, কেউ তাঁদের মনে করিয়ে দেননি। অনেকেই আবার এক-দেড় বছরের শিশুসন্তানকে নিয়েও ভ্রমণে বের হয়ে যাচ্ছেন। সবার মুখে এমন স্বর্গীয় হাসি দেখার এটা এক অন্য রকম আত্মতৃপ্তি।’

একা একা ভ্রমণ শুরু করলেন নারী। পরিবারের নানা বাধা ডিঙিয়ে। ২৫-৩০ জন নারীকে নিয়ে নিয়মিত এমন আয়োজনে নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখতে হয় সবার আগে। ফ্লাই ফার লেডিস তাই কোথাও ভ্রমণের শুরুতে সেই এলাকার পর্যটক পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেয়। পৌঁছে থানায় অবগত করে। নিয়মিত তারা পুলিশের ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। তাই নিরাপদ ভ্রমণ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না নারীদের।
একা কিংবা পরিবারের সবাই মিলে বেড়াতে গেলে আর্থিক ভাবনাটা বেশি ভাবতে হয়। এ রকম গ্রুপ করে বেড়ালে বেড়ানোটা বাজেট ফ্রেন্ডলি হয়। তাই সবাই খুব উৎসাহ বোধ করেন।

একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এমন উদ্যোগ হাতে নিয়ে ও সফল হয়ে খুব খুশি নুসরাত জাহান। নিজের এমন চ্যালেঞ্জিং, স্বাধীনচেতা পেশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন উদ্যোগের শুরুতে খুব বাধাবিপত্তি থাকে। যতটা বাধাবিপত্তির কথা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে বেশিই সমস্যায় পড়তে হয়েছে আমাকে। সবকিছু উতরে এখন নিয়মিত ভ্রমণ করি। ভ্রমণে নিজেদের মধ্যে সবাই যখন তাঁদের খুঁজে পান, সেই দৃশ্য নিয়মিত দেখার মধ্যে যে আনন্দ, তার তুলনা নেই। আমাদের সঙ্গে ভ্রমণের মাধ্যমে নারীরা তাঁদের হারানো মন খুঁজে পান। নিজেদের আবিষ্কার করেন নতুন রূপে। আমি নিজে স্বাধীনচেতা। এমন স্বাধীন বেড়ানোর সুযোগ করে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।’