মুরগির খামার করে স্বাবলম্বী শিক্ষার্থীরা

বগুড়ায় নিজের খামারে জাকারিয়া হোসেন
সোয়েল রানা

স্কুল-কলেজের বেতনের টাকা ঠিকমতো দিতে পারেননি জাকারিয়া ইসলাম। পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বেশ কয়েকবার। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা আবদুর রশিদের ওপর যে বড্ড চাপ, সেটাও তিনি বুঝতে পারছিলেন। শেষমেশ ঋণ করে ছয় হাজার টাকা জোগাড় করেন জাকারিয়া। তারপর ৪০টি দেশি মুরগির বাচ্চা কিনে বাড়ির পরিত্যক্ত ঘরে লালন–পালন শুরু করেন। সেটা প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা।

এখন জাকারিয়া বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়েন। তাঁর খামারে মা মুরগির সংখ্যা ৫০০। একসঙ্গে ৩৭ হাজার ডিম ফোটানোর জন্য আছে নিজস্ব হ্যাচারি। বাড়িতে ছয়টি গরু পালন করছেন তিনি। খামারের জন্য দুই লাখ টাকায় দুই শতক জমি কিনেছেন। খামার ও হ্যাচারি মিলিয়ে এখন তাঁর পুঁজির পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ টাকা। প্রতি মাসে জাকারিয়া প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় করেন। সেই টাকায় চলছে পড়াশোনা, বাড়ছে খামারের পরিধি।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় জাকারিয়ার মতো এমন অনেক শিক্ষার্থী ও সদ্য পড়াশোনা শেষ করা তরুণেরা পোলট্রি খামার করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। হয়েছেন সচ্ছল, স্বাবলম্বী ও সফল উদ্যোক্তা। তাঁদের খামারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখান থেকে প্রতি মাসে ৪ হাজার কেজি দেশি মুরগির মাংস ও প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ডিম পৌঁছে যায় সারা দেশে।

স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়ি

শিক্ষার্থী ও তরুণদের খামার করার দিকে আগ্রহী করতে শেরপুর উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জন মো. রায়হানের বড় ভূমিকা আছে। ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়ি’ নামে একটি উদ্যোক্তা পাঠশালার মাধ্যমে দেশি মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এই কর্মকর্তা। রায়হান বলেন, ‘বাঙালির পাতে প্রাণীজ আমিষ সরবরাহে মুরগি ও মুরগির ডিমই তো ছিল ঐতিহ্য। প্রাণীজ আমিষ উৎপাদনে আমি শিক্ষার্থী ও তরুণদের যুক্ত করতে চেষ্টা করেছি।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন সোহানুর রহমান। গত বছরের মার্চ মাসে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলে শেরপুরে নিজ গ্রাম ধরমোকামে ফেরেন তিনি। সোহানুর বলছিলেন, ‘ঘরবন্দী সময়ে একঘেয়ে লাগছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, এলাকার অনেকেই দেশি মুরগির খামার করে ভালো আয় করছেন। আমিও খামার করলাম। এখন আমার খামারে শুধু লেয়ার মুরগির সংখ্যা ১০০। একেকটি মুরগি টানা চার মাস ডিম দিচ্ছে। ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করছি। প্রতিটি বাচ্চার দাম গড়ে ২৫-৩০ টাকা। খামার থেকে প্রতি মাসে গড়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা বাড়তি লাভ হচ্ছে।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মোহাম্মদ নাজমুলও পড়ালেখার পাশাপাশি শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামে দেশি মুরগির খামার গড়েছেন। তাঁর খামারে এখন ২০০ মুরগি রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের বাড়ি মানেই মুরগির খামার

শেরপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, অনেক শিক্ষার্থীর বাড়িতেই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় মুরগির খামার। শুভগাছা গ্রামে যেমন দেখা হলো তানজিমা আকতারের সঙ্গে। শেরপুর ডিগ্রি কলেজের এই শিক্ষার্থী বাড়ির আঙিনায় খামার গড়েছেন। তানজিমাকে সহায়তা করেন তাঁর স্বামী আল আমিন।

তানজিমা বলেন, ‘২০১৫ সালে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়েছিল। সংসারে অভাবের কারণে অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয়। পরে ২০১৬ সালে ১৪টি দেশি মুরগির বাচ্চা দিয়ে খামার শুরু করি। তিন মাস পর খরচ বাদে ১৩ হাজার টাকা লাভ হয়। এখন আমার খামারে প্রায় ৫০০ মুরগি আছে। খামারের আয় থেকেই অনার্সের পড়ালেখাটা চালিয়ে যেতে পারছি।’

শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের খন্দকারটোলা গ্রামে বাড়ির ফটকে ঝুলছে ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়ি’ লেখা ডিজিটাল ব্যানার। এ গ্রামে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাড়ি মানেই একেকটি খামার। আছে হ্যাচারিও। দেশের বিভিন্ন জেলার খামারিরা এসব হ্যাচারি থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, খামারের মুরগি পালনে অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধের বদলে তাঁরা অরগানিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন করছেন। করোনাকালে অনেকের পরিবারই আর্থিক সংকটে পড়েছিল। কিন্তু বাড়িতে থাকার সময়টা কাজে লাগিয়ে মুরগির খামার করে সাহস পেয়েছেন তাঁরা।