মূল্যবৃদ্ধিরও বড় মূল্য দিচ্ছেন পারভিনরা

কারওয়ান বাজারে সবজি বাছাইয়ের কাজ করতেন পারভিন বেগম। এই বাজারেরই পাশের তেজকুনিপাড়ার খানকার গলিতে থাকেন তিনি। গত ফেব্রুয়ারিতে কোমরের প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে বাধ্য হন। চিকিৎসক তাঁকে কিছু ওষুধ দিয়ে জানান, এভাবে আর বসে থেকে কাজ করা যাবে না। অন্তত ছয় মাস কাজের বাইরে থাকতে হবে। পারভিনও আর পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত কাজ ছেড়ে দেন। স্বামী, মেয়ে আর নাতি নিয়ে তাঁর চারজনের সংসার। স্বামী রাজমিস্ত্রি, মেয়েটি একটি বাসায় কাজ করে। স্বামী ও মেয়ের আয়ের সঙ্গে তাঁরটা মিলিয়ে অভাবের সংসার মোটামুটি চলে যেত। কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চলছিল সংসার। তবে গত মাস থেকে চাল, ডাল, তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। অগত্যা চিকিৎসকের বিধিনিষেধের পরও বাধ্য হয়ে আবার কাজ শুরু করেছেন।

পারভিন বেগম বলছিলেন, ‘অসুখের কথা চিন্তা কইরলে কি আর অয়। গরিব মানুষ, কষ্ট কইরা অইলেও কাজ তো করতে অইব।’

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সবজি বাছাইয়ের কাজ করেন অনেক নারী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

দুই বছর ধরে করোনার প্রকোপে দেশের অন্তত দুই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, একাধিক গবেষণায় তা পাওয়া গেছে। সেই পরিস্থিতি থেকে একটু উত্তরণ যখন হচ্ছিল, এর মধ্যেই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে পণ্যের দাম। এপ্রিল থেকে মে মাসে দফায় দফায় বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। গত রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মে মাসের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। দেখা গেছে, হঠাৎ মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। গত মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। এপ্রিলে এই হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির এত বড় উল্লম্ফন গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি।

মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধির মতো অর্থনীতির ভারী ভারী শব্দ পারভিন বেগমের মতো মানুষেরা জানেন না। তাঁরা শুধু জানেন বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর লড়াই। এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির বড় অভিঘাত নারীদের ওপরই পড়েছে বেশি। চলতি মাসে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের নারীরা নতুন করে আবার কর্মক্ষেত্রে ঢোকার চেষ্টা করছেন।

নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর করোনার আর্থসামাজিক প্রভাব নিয়ে চার দফা জরিপ করে পিপিআরসি ও বিআইজিডি। ২০২০ সালের এপ্রিল ও জুন–জুলাই এবং ২০২১ সালের মার্চ ও আগস্ট–সেপ্টেম্বরে চার দফায় সাধারণ মানুষের ওপর করোনার প্রভাবসংক্রান্ত জরিপ হয়। চলতি মাসে ‘মূল্যস্ফীতি, খাপ খাওয়ানো ও পুনরুদ্ধারের প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক পঞ্চম দফার ফল প্রকাশ করা হয়। এ দফার জরিপের কাজ চলে গত ১৪ থেকে ২১ মে পর্যন্ত। অংশ নেন গ্রাম ও শহরের ৩ হাজার ৯১০ জন।

জরিপ অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে ৪৮ শতাংশ নারী বাইরে কাজ করতেন। এ বছরের জানুয়ারিতে তা কমে ৪০ শতাংশে নেমে আসে। তবে মে মাসে ৫২ শতাংশ নারী কাজে যুক্ত হন। পারিবারিক অনটনের কারণে বাইরে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন এসব নারী।

তবে এই জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, কোভিডের সময় যেসব নারী কাজ হারিয়েছিলেন, তাঁদের ৩৪ শতাংশই এখনো কাজ পাননি। তাঁদের ৩৪ শতাংশ এখন নতুন কাজ করছেন। আর ৩০ শতাংশ কোভিড-পূর্বের সময়ের কাজেই আছেন।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডের ধাক্কায় শ্রমবাজার থেকে যে নারীরা ছিটকে পড়েছিলেন, তাঁদের সেখানে ফিরে আসার পথ সহজ ছিল না। নিত্যপণ্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের নতুন কোনো আয়ের পথ বের করতে বাধ্য করেছে। তাঁরা হয়তো বাড়তি কাজ করছেন বা শ্রমঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়েছেন। হোসেন জিল্লুরের মতে, স্বস্তির জন্য মানুষ আয় করেন। কিন্তু এখন তাঁদের কাজে স্বস্তি নেই, বরং এটি অনিশ্চয়তায় ভরপুর। আয় ও স্বস্তির মধ্যে ফারাক বাড়ছে দিন দিন।

নতুন করে কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হওয়া বা কোভিডের জন্য কাজ হারানো নারীদের প্রায় সবাই অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে জড়িত। এই জরিপে বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে সবচেয়ে আর্থিক অনটনের মধ্যে যে কর্মজীবী গোষ্ঠী পড়েছে, তাদের মধ্যে নারী গৃহকর্মী রয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক প্রথম আলোকে বলেন, অনেক নারীই কাজে সম্পৃক্ত হন তাঁর সক্ষমতা বাড়াতে বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। কিন্তু এখন তাঁদের অনেককে বাধ্য হয়ে কাজে সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে। নারীদের সত্যিকারের ক্ষমতায়নের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকা দরকার। যেখানে এসব প্রান্তিক নারী সুযোগ পাবেন।