মেয়েরা বদলে দেয় বাবার মনোজগৎ?
বাবা-মেয়ের সম্পর্কটাই আলাদা, পৃথিবীর সব সম্পর্ক থেকে একটু বেশিই আলাদা, বিশেষ। সম্পর্কটা ভয়-শ্রদ্ধা-নির্ভরতার মিশেল। মেয়ের চোখে বাবা ‘আইডল’। বাবা কী বলেন, কীভাবে চলেন আর কী ভাবেন—সেসব মেয়ের মনে ভীষণ দাগ কাটে। তবে গবেষণা বলছে, উল্টোটাও ঘটে। মেয়ের ভাবনা, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বাবার মূল্যবোধ আর বিশ্বাসের জগৎকে নাড়িয়ে দেয়, প্রভাবিত করে, সমৃদ্ধি জোগায়।
উদাহরণের জন্য খুব দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের আশপাশে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ মিলবে। স্ত্রীকে চাকরি করতে দেননি কিন্তু কর্মজীবনে মেয়ের সাফল্যে গর্বিত বাবার সংখ্যা বাংলাদেশের সমাজে কম নয়। স্ত্রী হয়তো ভালো গান গাইতেন, বিয়ের পর স্বামী গানটা আর চর্চা করতে দেননি। অথচ মেয়েকে গান গাইতে শুনে ছুটে গেছেন গানের শিক্ষকের কাছে, শেখাতে। একটু সুযোগ পেলেই মেয়ের গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীও অপূর্ব সেতার বাজাতেন। প্রচলিত আছে, সেতার বাজানো নিয়ে মনোমালিন্যের জেরে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। সেই থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত অন্নপূর্ণা দেবী আর কখনোই কোনো অনুষ্ঠানে সেতার বাজাননি। তবে অন্য দুই সংসারের দুই মেয়ে নোরা জোন্স আর আনুশকা শঙ্করের সংগীতপ্রতিভা ও সাফল্যে আর দশটা বাবার মতোই গর্বিত ছিলেন তিনি।
চীনের চায়না ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্কুল ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামি রীতিমতো গবেষণা করে দেখিয়েছে, বাবার কর্মজীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কন্যা কতটা প্রভাব ফেলে। এ জন্য তারা ১৯৯২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটেছে।
জার্নাল অব ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিকসে গবেষণাটি কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়। গবেষণার শিরোনাম ছিল—যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) কর্মক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানেরা কোনো ভূমিকা রাখে কি না। উত্তর পেতে ২০ বছরে সিইওরা করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব কতটুকু আর কীভাবে পালন করেছেন, তা খুঁজে দেখা হয়।
মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস বলছে, ৩৭৯ জন সিইও আর তাঁদের ৯৪৩ সন্তানের তথ্য ঘাঁটলে বেরিয়ে আসে অন্য রকম তথ্য। যেসব সিইও কন্যাসন্তানের বাবা, তাঁরা করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালনে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অন্যদের চেয়ে এই খাতে ১০ শতাংশের বেশি খরচ করেছেন। তাঁরা কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কর্মিবান্ধব ও উদার করতে তৎপর ছিলেন তাঁরা। তাঁদের হাত ধরে চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন নানা আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা কর্মীরা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গগত বৈষম্য দূর করার একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা তাঁদের ছিল। উচ্চ বেতনে নারী কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন। সমাজ, পরিবেশ, মানবাধিকারের মতো বিষয়ে করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালনে তাঁরা ছিলেন সচেতন ও সক্রিয়।
সিইও বাবাদের জীবনে মেয়ের প্রভাব কেমন, তার বড় উদাহরণ মার্ক জাকারবার্গ। ফেসবুকের এই সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও তাঁর স্ত্রী প্রিসিলা চ্যানের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন চ্যান জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ। তাঁদের এই দাতব্য কাজের শুরু ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর, তাঁদের বড় মেয়ে ম্যাক্সিমা চ্যান জাকারবার্গের জন্মের দিনে। এই দম্পতি ফেসবুকে তাঁদের শেয়ারের ৯৯ শতাংশ দাতব্য কাজে ব্যয়ের ঘোষণা দেন সেদিন। দুই মেয়ে ম্যাক্সিমা ও আগস্টের জন্য সুন্দর পৃথিবী নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অর্থ ব্যয় করছেন জাকারবার্গ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিয়াজ ফর লিডারস বলছে, একজন মেয়ে তাঁর বাবার ভাবনাকে বদলাতে পারে। এর সপক্ষে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব আইনপ্রণেতার এক বা একাধিক মেয়ে আছে, তাঁরা গর্ভপাতের মতো নারীর প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ে উদার। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি রক্ষণশীল রিপাবলিকান। রাজনৈতিক আদর্শের কারণে তাঁর সমলিঙ্গের বিয়ের বিরোধী হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি সমলিঙ্গের বিয়ের পক্ষে ছিলেন। কারণ, তাঁর কন্যা সমকামী।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বড় মেয়ের জন্মের বছর চারেক পর সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের সঙ্গে গড়ে তোলেন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। ২০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী দরিদ্র দেশের স্বাস্থ্য খাতে অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছে। দুই মেয়ে মালিয়া ও সাশা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জীবন কতটা বদলে দিয়েছে, সে কথা তিনি নিজেই বলেছেন। বুদ্ধিদীপ্ত ও স্মার্ট দুই মেয়ের জনক হিসেবে সব সময়ই নিজেকে ভাগ্যবান বলে থাকেন তিনি। একটা ছেলের সমান সুযোগ-সুবিধা যেন একটা মেয়েও পায়, তেমন পৃথিবী গড়ার জন্য আমৃত্যু লড়ে যাওয়ার অঙ্গীকার তাঁর।
বাবাদের মনোজগতের বদলের প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, নানা কারণে বাবারা এমন করে থাকেন। তবে সবচেয়ে বড় কারণ বোধ হয়, মেয়েদের মায়ার বাঁধনে জড়াতে পারার ক্ষমতা। মেয়েরা বাবার সঙ্গে মানসিকভাবে ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি জড়িয়ে থাকে। ফলে ছোটবেলা থেকেই মেয়ের ভাবনা, জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতাগুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেন বাবা। অন্যের হাতে থাকা সেসব প্রতিবন্ধকতার সব কটি হয়তো তিনি সমাধান করতে পারেন না, তবে নিজের সাধ্যের মধ্যে থাকা সবটুকু করতে একটুও পিছপা হন না। এভাবেই ধীরে ধীরে বদল ঘটে বাবার মনোজগতে।