মোহনা

হলঘরের সামনের দিকে মানুষের গুঞ্জন, ফিসফিসানি আর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। মনটা খারাপ থাকলে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। তাই পেছনে গিয়ে একাকী বসে আছি। দুপাশের চেয়ারগুলো বেশির ভাগই ফাঁকা। বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠান আমি পারতপক্ষে বাদ দিই না। কিন্তু উপজেলা সদরের অনুষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা আসেন। তাদের রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজির গলাবাজি আর ফোলানো-ফাঁপানো কথাবার্তা বলেন, আমার ভালো লাগে না। সে তুলনায় শহরের এক প্রান্তে আমার বাড়ির কাছের এই অনুষ্ঠানে আসতেই ভালো লাগে। মিলনায়তনে জৌলুশ নেই। নেই ভাড়াটে নামী শিল্পীও। এলাকার শখের শিল্পীরাই আবৃত্তি, গান, নাচ করে। তবু অনুষ্ঠানজুড়েই থাকে পরম আন্তরিকতা আর মমতার ছোঁয়া।

একদল তরুণের দলগত আবৃত্তি দিয়ে সেদিন অনুষ্ঠান শুরু হলো। তারপর এল কখনো শিশু-কিশোর, কখনো বড়দের নাচ-গান-আবৃত্তি। একসময় উপস্থাপক ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানল। অনুষ্ঠান শেষ হতেই দর্শক হুড়মুড় করে বের হতে শুরু করল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত নয়টা চল্লিশ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হলঘর অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেল। অল্প কয়েকজন আছেন, যারা ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন দরজার দিকে। আয়োজকেরা মঞ্চ গোছগাছ করতে ব্যস্ত।

চারপাশ ফাঁকা হতে দেখে সিট ছেড়ে উঠলাম। বের হওয়ার একটাই দরজা, সামনের দিকে, মঞ্চের কাছাকাছি। ওদিকে এগোতেই দূর থেকে চোখে পড়ল একজন নারীকে, দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় কালো পোশাকের ভেতর দিয়ে তার ফরসা মুখটাই শুধু উজ্জ্বল হয়ে আছে। হয়তো সে সামনের দিকেই বসে ছিল। মেয়েদের জন্য সাধারণত মঞ্চের সামনের দিকেই আসন দেওয়া থাকে। তার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি হলঘরের ভেতরে চারপাশে ঘুরছে। একবার তার মুখটা দেখা যাচ্ছে, আবার মানুষের কারণে মুখটা আড়াল হয়ে যাচ্ছে।

দরজার কাছাকাছি আসতেই থমকে গেলাম। আমার দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে আরিয়া। ছোট মেয়েটা মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার গা ঘেঁষে। স্থবির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেলাম সামনে এসে। চোখের পাতা পড়ে না আরিয়ার। হাত ধরে থাকা বাচ্চা মেয়েটা থুতনি উঁচু করে হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে বারবার।

ডিসেম্বর মাস। হালকা শীত পড়েছে। কালচে মেরুন রঙের প্রিন্টের শাড়ির ওপর দিয়ে হালকা সুতোর কাজ করা কালো রঙের একটা শাল চড়ানো গায়ে। প্রায় কালো পোশাকের ভেতর দিয়ে তার ফরসা মুখটা ফুটে বেরিয়ে এসেছে এক উজ্জ্বল দ্যুতি নিয়ে। তেমন সাজগোছ করেনি। তবু তাকে অসম্ভব সুন্দর আর মোহনীয় লাগছে এ মুহূর্তে। দুচোখের কোণে জল চিকচিক করছে। মুখজুড়ে তার বেদনার্ত আনন্দ।

আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।

খুব অভিমানী দৃষ্টি হেনে বলল আরিয়া, ফোন বন্ধ রেখেছ। আমি জানতাম তুমি এখানে আসবে। আমাকে কষ্ট না দিলে বুঝি তোমার ভালো লাগে না? চলো।

হলঘরের পাশ দিয়ে লম্বা করিডর। নিঃশব্দে হাঁটছি আমরা আলো-আঁধারির মধ্য দিয়ে।