
১১ বছরের টুম্পাকে ইদানীং যেন তার মা একেবারে চিনতে পারেন না। সেদিন পর্যন্ত যে মেয়েটি মায়ের পায়ে-পায়ে ঘুরত, মায়ের কাছ ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, সেই মেয়েটি ইদানীং কেমন ঝাঁজিয়ে ওঠে কথায় কথায়। অন্যদিকে একই অভিযোগ তমালের মায়েরও। মায়ের একান্ত বাধ্য বলে পরিচিত ছেলেটি ১২ না পেরোতেই আজকাল মায়ের কোনো কথা একেবারে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনে না। কথায় কথায় উত্তেজনা, আর মায়ের সঙ্গে রাগ দেখানো যেন আজকাল প্রতিদিনের ব্যাপার।
কৈশোরে পা দেওয়া সন্তানের এই আচরণের পরিবর্তনের অভিযোগটা অনেক বাবা-মায়েরই। আর সংঘর্ষটা যেন বা মায়ের সঙ্গেই ঘটে বেশি।
স্বাধীনচেতা মনোভাব
বাবা-মায়ের আগল থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব সত্তায় স্বাধীনভাবে প্রকাশিত হওয়ার প্রবণতা এ সময়ের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি কাজে নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য দেওয়া, স্বাধীনভাবে বন্ধু নির্বাচন নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনযাপন, জামাকাপড় পরা এই স্বাধীনচেতা মনোভাবেরই একটা অংশ।
আবেগপ্রবণ পরিবর্তন
কৈশোরে সন্তানের আবেগ একধরনের টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। আবেগ অর্থাৎ রাগ, আনন্দ, ঘৃণা ইত্যাদি সবকিছুই এ সময় একটু বেশি পরিমাণে থাকে। অপরিপক্ব ও অনিয়ন্ত্রিত আবেগ এ সময়ের এক ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যও বটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্তগুলো আবেগনির্ভর, সেখানে এই সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ ফলাফল কী হবে বা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সেটা বিবেচনায় থাকে না।
রাগ হলে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া, যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা, কাউকে ভালো লাগলে দ্রুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি এ সময়ের অপরিপক্ব আবেগেরই একধরনের প্রকাশ।
নিজস্ব মতামত তৈরি ও তর্কপ্রিয়তা
কৈশোর সময় থেকেই মূলত আমদের চারপাশ, জীবন-জগৎ থেকে একেবারেই নিজস্ব মতামত তৈরি হতে শুরু করে। ঠিক-বেঠিকের একধরনের ধারণাও তাদের মধ্যে তৈরি হয়। এসব ভাবনার মধ্যে একধরনের পরিপক্বতা থাকলেও তাদের মতামতকেই গুরুত্বপূর্ণ ও ঠিক মনে করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের সঙ্গে মতামতে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠতে পারে। যে সন্তান কিছুদিন আগেও বাবা-মায়ের যেকোনো নির্দেশ বিনা প্রশ্নে মেনে নিত, কৈশোরে সে সন্তানই বাবা-মায়ের মতামতের বিরুদ্ধে নানা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া শুরু করে।
নিজস্ব জগৎ তৈরি
নানা বিষয় নিয়ে রঙিন কল্পনা আর ফ্যান্টাসির একেবারেই ব্যক্তিগত জগৎ তৈরি হয় কৈশোরে। চারপাশে বড়দের জগৎ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখে নিজস্ব এই জগতে বুঁদ হয়ে থাকাও এ সময়ের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য।
বন্ধুবান্ধবদের প্রতি আগ্রহ
শৈশবে যেমন একজন শিশুর জগতে কেন্দ্রবিন্দু থাকে বাবা-মা, কিন্তু কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা-মায়ের সঙ্গে সমবয়সী বন্ধুবান্ধবেরা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় তৈরি বা অন্যান্য সামাজিক দক্ষতা তৈরিতে বন্ধুবান্ধবদের এই গুরুত্ব অনেক।
কেন এই সংঘাত?
যে পরিবর্তনগুলোর কথা বললাম, সেগুলো এ সময়ের একটা সাময়িক অবস্থা। নানারূপে, নানাভাবেই এই পরিবর্তনগুলো সম্পূর্ণ কৈশোরকাল ধরে চলে এবং প্রাপ্ত বয়সে একধরনের সম্পূর্ণ ও পরিপক্ব মানসিক গঠন তৈরি হয়।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানের এই পরিবর্তনটা স্বাভাবিক বা সাময়িক হিসেবে দেখেন না। হঠাৎ এই পরিবর্তনের সঙ্গে মা-বাবার ঠিকমতো খাপ খাওয়াতে না পারাই মূলত তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষের মূল কারণ। অতিরিক্ত উদ্বেগের ফলে মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, মতামত চাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি আচরণ সম্পর্কটাকে অনেক তিক্ত করে ফেলে। মা যেহেতু সন্তানদের বেশি কাছে থাকেন এবং উদ্বেগটাও বেশি করে থাকে, ফলে তাঁর সঙ্গে সন্তানদের সংঘাতটাও হয় বেশি।
কেমন আচরণ করবেন আপনার কিশোর সন্তানটির সঙ্গে
মনে রাখবেন সন্তানের এই টালমাটাল ও ঝুঁকিপূর্ণ এ সময়টাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আপনার সঙ্গে তার পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে তৈরি বন্ধুত্বের সম্পর্ক। অধিক প্রশ্রয় বা কঠিন শাসন কোনোটাই এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। আপনার অবাধ ভালোবাসার নিরাপত্তাবোধ, সঠিক দিকনির্দেশনা ও দৃঢ়তা আপনার সন্তানের এই টলটলে সময়টার সুন্দর করে পার করে নিয়ে যেতে পারে।
* অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীন মনোভাবে অসম্মান প্রদর্শন থেকে বিরত থাকুন।
* সন্তানের কিছু কিছু স্বাধীন ইচ্ছা মূল্যায়ন করুন। তার মতামত মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করুন।
* কোনো কারণ গ্রহণযোগ্য মনে না হলে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুণ এবং প্রয়োজনে সুস্পষ্টভাবে আপনার অবস্থান জানান এবং তাকে মেনে নিতে সাহায্য করুন।
* এ বয়সে সন্তানের আবেগের নিয়ন্ত্রণহীনতার কথা মাথায় রাখুন। সমালোচনা করা, আত্মসম্মানে আঘাত করা থেকে বিরত থাকুন। অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে বকা দেওয়ার বা শাস্তির বদলে আদর করা। পকেট মানি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করুন।
* সন্তানের নিজস্ব জগতের প্রতি সম্মান দেখান। গোপন নজরদারি, যেমন তার অজান্তে ব্যাগ, ড্রয়ার, ব্যক্তিগত ডায়েরি ইত্যাদি চেক করবেন না। এতে সন্তানের আপনার প্রতি আস্থা ও সম্মান দুটিই নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
* তবে ব্যক্তিগত মোবাইল, ট্যাব, ফেসবুক ইত্যাদি ক্ষেত্র বিশেষ একধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পারে বলে এসবের ব্যবহার সীমিত রাখুন।
* বন্ধুবান্ধবদের সম্পর্কে সরাসরি সমালোচনা থেকে বিরত রাখুন।
* সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে জানুন। সন্তানের বন্ধুদের বাসায় আসা-যাওয়ায় উৎসাহ দিন।
* ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের সঙ্গে অনন্ত দিনে একবেলা টেবিলে বসে একসঙ্গে খান।
* তাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে, আগ্রহের বিষয় নিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কথা বলুন।
মেখলা সরকার: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।