যা আসছে ২০২১ সালে

নতুন বছরের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছেছবি: পেকজেলস ডট কম

জীবনযাপনের ট্রেন্ড কী হবে সামনের বছর? বছরের একেবারে শেষের সময়গুলোতে আমাদের মনে এ প্রশ্নটি ঘুরপাক খায়। বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল, লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন সব জায়গাতেই এই ব্যাপারটা নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলতে থাকে। আমরাও তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি জীবনযাপনের বড় পরিবর্তনগুলোর পূর্বাভাস জানার জন্য। ২০২০ সাল ছিল মহামারির বছর।

মহামারি থেকে বাঁচতেই আমাদের জীবনযাপনে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। স্ফিংকস পাখির মতো মহামারির ভস্মস্তূপ থেকে নতুন জীবনীশক্তি, সাহস আর আশা নিয়ে পুনর্জন্ম নিতে চাচ্ছে মানুষ। বিদায় নেওয়া ২০২০ সাল আমাদের যা কিছু শিখিয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরো পৃথিবীতেই নতুন বছরের দিন বদলের পালায় জীবনযাত্রায় আসছে ৬টি যুগান্তকারী পরিবর্তন।

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল

সঠিক খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, উপযুক্ত ব্যায়াম, ন্যাচারাল থেরাপি এসবই আমাদের নতুন বছরের সঙ্গী হবে
ছবি: প্রথম আলো

করোনা প্রতিরোধ, করোনা–পরবর্তী সেরে ওঠার প্রক্রিয়াকে জোরদার করে তোলা আর শরীরে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমরা বাধ্য হয়েছি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনকে আপন করে নিতে। আমরা বুঝতে শিখছি, শুধু করোনা নয়, হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, মরবিড ওবেসিটি, কিডনি রোগের যেকোনোটিই খুব বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তার ওপরে আছে যেকোনো জায়গা থেকে সহজে সংক্রমণের ভয়। এ জন্য বিশ্বজুড়ে সবাই সুস্বাস্থ্যকেই এগিয়ে রাখছে নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা বা নিউ ইয়ার রেজল্যুশনের ক্ষেত্রে। সঠিক খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, উপযুক্ত ব্যায়াম, ন্যাচারাল থেরাপি এসবই আমাদের নতুন বছরের সঙ্গী হবে। এ ছাড়া পরিসংখ্যান বলছে, সামনের বছর ধূমপান ত্যাগ আর মাদককে না বলার সব রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী।

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন

আধুনিক কালে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, কোমল পানীয়, ফাস্ট ফুড, ইনস্ট্যান্ট খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদির দিকে সবাই বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে গিয়েছিল। আমাদের দেশেও অন্তত শহরগুলো এই পথেই চলছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখন সাধারণ মানুষ খাদ্যাভ্যাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। অরগানিক, বিষমুক্ত, রাসায়নিকমুক্ত, খাঁটি খাদ্য উপাদানের দিকে মানুষের আগ্রহ অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বছরজুড়ে। এ অবস্থা জারি থাকবে সামনের দিনগুলোতেও।

অরগানিক, বিষমুক্ত, রাসায়নিকমুক্ত, খাঁটি খাদ্য উপাদানের দিকে মানুষের আগ্রহ অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বছরজুড়ে
ছবি: পেকজেলস ডট কম

ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, কোমল পানীয় আর ফাস্ট ফুডের বিক্রি কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। বাংলাদেশে কৃষকদের থেকে পাওয়া খাদ্যশস্য, গ্রামীণ উৎসস্থল থেকে সংগ্রহ করা মধু, তেল, হাঁস–মুরগি, মুদি সামগ্রী, নিরাপদ মাছ, মাংস, শাকসবজি, দুধ, ডিমের প্রতি আগ্রহ নতুন বছরেও সমানভাবে জারি থাকার কথা। এমনকি এখন হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন দেশি ধানের চাল, কাউন, যব বা কলাইয়ের আটার মতো পুষ্টিকর খাদ্য মানুষের হেঁশেলে ফিরে আসছে। স্থান করে নিচ্ছে আমাদের খাদ্যতালিকায়।

ব্যায়ামেই সুস্থতা

ব্যায়ামের সুফল বুঝতে পারছে এখন বয়স নির্বিশেষে মানুষ
ছবি: পেকজেলস ডট কম

তাড়নাটা ছিল করোনা থেকে বাঁচার। তাই দীর্ঘ লকডাউনে ঘরবন্দী মানুষের ঘরের ভেতরে ট্রেডমিলে দৌড়ানো, মুক্ত হস্তে ব্যায়াম, এগোবি, যোগব্যায়াম, স্কিপিং এগুলোর প্রচলন বেড়েছিল। এগুলো আর আমাদের ছেড়ে যাবে বলে মনে হয় না। যোগব্যায়ামের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভের বিষয়টি জড়িয়ে থাকায় এর গুরুত্ব সামনের বছরেও সমান থাকবে। এ ছাড়া জুম সেশনের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সে সম্মিলিতভাবে যোগব্যায়াম, এগোবি, জুমবা ইত্যাদি করার যে প্রচলন শুরু হয়েছে, তা সামনে আরও জোরদার হওয়ার কথা। ব্যায়ামের সুফল বুঝতে পারা মানুষ এখন বয়স নির্বিশেষে প্রতিদিন সময় করে মাস্ক পরে বাইরে জগিং করতে বা হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে। যেকোনো রোগ প্রতিরোধ করতে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সামনের বছরেও ব্যায়ামের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ারই কথা। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে ডিউ ওয়াকিং বা ভোরের শিশিরভেজা ঘাসে হাঁটার প্রবণতা।

সবার আগে পরিবার

ফ্যামিলি কামস ফার্স্ট—ইংরেজি এই স্লোগানটি এখন আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠবে। করোনা–পূর্ববর্তী জীবন ছিল শুধুই উদ্দেশ্যবিহীন ছুটে চলার জীবন। সাফল্য, টাকাপয়সা, উন্নতি অথবা শুধুই নিছক সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সে অস্থির জীবনযাপনে পরিবারের সঙ্গে ভালো একটা সময় কাটানো যেন অসম্ভব একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। একসঙ্গে টেবিলে বসে খাওয়া, একসঙ্গে ইনডোর গেম, যেমন লুডু, ক্যারম বা দাবা খেলা, ঘরের কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া, বাগান করা, শখের কোনো কিছু বানানো, রান্না করা এসব যেন শাপেবর হয়ে ফিরে এসেছে আমাদের পারিবারিক জীবনে।

সাফল্য, টাকাপয়সা, উন্নতি অথবা শুধুই নিছক সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার অস্থির জীবন আর দেখা যােব না। পরিবর্তন আসছে
ছবি: পেকজেলস ডট কম

আশপাশের মানুষকে স্বজন হারাতে দেখা অথবা নিজের আপনজনের অসুস্থতায় তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে সামনের বছর আরও দৃঢ় করবে এমনই মনে করছেন সবাই। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠে ২০২০–এর বিষক্রিয়ায় তালাকের হার বাড়ছে খুব আশঙ্কাজনকভাবে। সেটিও বাস্তবতা।

অপরিহার্য মাস্ক জীবনে ও ফ্যাশনে মাস্ক এবং নো মাস্ক নো সার্ভিস

বিশ্বব্যাপী এখন করোনা প্রতিরোধে অপরিহার্য মাস্ককে এক অনন্য ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ‘ভোগ’–এর মতো ফ্যাশন হাউস এখন ডিজাইনার ফ্যাব্রিক মাস্ক বানাচ্ছে। মাস্কে শোভা পাচ্ছে মজার মজার ডিজাইন, মুখচ্ছবি, বিভিন্ন মেসেজ ও ডায়ালগ। ইতিমধ্যে মার্কিন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন আমেরিকার বিখ্যাত প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে মাস্ক পরে এসে তার প্রমাণ দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী বরেণ্য তারকারা মাস্ককে ফ্যাশনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছেন সাধারণ মানুষের কাছে। এখন থেকে ঘরের বাইরে মাস্ক না পরাটা বিশ্বব্যাপী চরম অসভ্যতার শামিল হয়ে দাঁড়াবে। আর সেই সঙ্গে স্মার্ট, সুন্দর, উপযোগী মাস্ক প্রমাণ করবে আপনি কতটা সচেতন আর ফ্যাশনেবল।

অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে মাস্ক
ছবি: পেকজেলস ডট কম

শুধু ফ্যাশনেই নয়, যত দিন সাধারণ মানুষের জন্য টিকা সহজলভ্য হচ্ছে না তত দিন পৃথিবীর মানুষের জন্য মাস্কই ভরসা। এ জন্য ইতিমধ্যে সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ চালু করেছে। ফলে মাস্ক সামনের দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

জীবনে প্রযুক্তির বিস্তার

জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে প্রযুক্তি। এই খোদ বাংলাদেশেই ২০২০ সালে ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়েছে ৫০ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাপী মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাবের বিক্রি বেড়েছে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। টেলিমেডিসিন ডাক্তার দেখানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকা, বন্ধু-আত্মীয় সবার সঙ্গে অডিও–ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখা, হোম অফিসের কাজ ও ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করা, ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাস করা এসবই জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে প্রযুক্তির অপরিহার্যতা। এ ছাড়া দুনিয়াজুড়েই অনলাইনে খাবার, খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় সবকিছু বাসায় হোম ডেলিভারি আনার প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা দুটোই রয়ে যাবে সামনের বছরেও। আড্ডা হবে অনলাইনে, আলোচনা সভা হবে ভিডিও কনফারেন্সে, এমনকি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাও এখন ডিজিটাল কায়দায় হবে নতুন বছরে।

জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে প্রযুক্তি
ছবি: পেকজেলস ডট কম

আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই হবে ২০২১–এর মূলমন্ত্র। বিশ্বে করোনাযুদ্ধে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী মার্কিন ইমিউনোলজিস্ট ড. ফাউসিসহ অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন যে ২০২১ হবে ভ্যাকসিনের বছর। তবু সে পর্যন্ত মাস্ক পরা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন, জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এ বিষয়গুলোই ২০২১ সালে বিশ্বের সব সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিকের জীবনযাত্রার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে থাকবে।

সূত্র:

১। ‘দা এফেক্ট অব দা কোভিড ১৯ প্যান্ডেমিক অন স্মোকিং সিসসেশন সাকসেস’, বুরকু কায়হান তেতিক, ইসিলায় গেদিক তেকিনেমরে এবং সেরভেত তাস, কমিউনিটি হেলথ, জুলাই ২০২০,

২। ‘করোনাভাইরাস: স্মোকার্স কুইট ইন হাইয়েস্ট নাম্বারস ইন আ ডেকেড’, র‍্যাচেল শ্রায়ের , বিবিসি নিউজ, জুলাই ২০২০

৩। ইউ এন বি নিউজ, জুন ২০২০

৪। ‘ফেইস মাস্কস এজ আ ফ্যাশন এক্সেসরিজ? হোয়াই উই শুড এনকারেজ দিস ট্রেন্ড’, লিয়াহ ক্যাম্পবেল, হেলথলাইন, মে ২০২০

৫। ‘দা বিগেস্ট হেলথ ট্রেন্ডস অফ ২০২১: ফ্রম মাইক্রোগ্রিনস টু রিডিফাইন্ড জিম ওয়ার্কআউট’, ট্রেসি রোবেরো, ফিলিভয়েস, ডিসেম্বর ২০২০

৬। এড্রেসিনং ইকোনমিক অ্যান্ড হেলথ চ্যালেঞ্জেস অফ কোভিড - ১৯ ইন বাংলাদেশ: প্রিপারেসশন অ্যান্ড রেসপন্স’, বিজন কুমার এবং সুস্মিতা ডি পিঙ্কি, ওয়াইলি অনলাইন লাইব্রেরী, নভেম্বর ২০২০