যে কারণে আমি ফরমাল

আঁকা: জুনায়েদ
আঁকা: জুনায়েদ

ঢাকায় যে কটি যানবাহন চলে, অফিসে যেতে তার সব কটিই ব্যবহার করি আমি। বাসা থেকে বেরিয়ে শেয়ারে অটোরিকশায় চেপে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে আসি। বাসে ওঠার জন্য অলিম্পিকের তিন–তিনটি ইভেন্টে অংশ নিতে হয় আমাকে। প্রথমেই বাসের উদ্দেশে দৌড়, তারপর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী যাত্রীদের সঙ্গে কুস্তি (ঠেলাঠেলি) করে কোনোমতে বাসে ওঠা। এবং সবশেষে জিমন্যাস্টিকস—রড ধরে ঝুলে থাকা। রোজ এই ট্রায়ালথনে অংশ নিয়ে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছি। সেখান থেকে লেগুনায় চ্যাপ্টা হয়ে গুলশান। তারপর রিকশায় উঠে গলি আর জ্যাম পেরিয়ে অফিস! এত কায়দা করেও লাভ হয় না। অধিকাংশ দিন দেরি হয় আমার। ১০টায় অফিস। ১৫ মিনিট পর্যন্ত ইনজুরি টাইম। তারপর গেলেই পেনাল্টি। মানে ‘লেট’ আরকি! পরপর তিন দিন লেট হলেই ঘ্যাচাং-দাঁত বের করে বেতন কেটে নেবে এইচআর। ভাবটা এমন যে কেটে নেওয়া বেতনটা যেন তারাই পাবে! কোনো দিন শুনিনি, এইচআরের কারও বেতন কাটা গেছে! চাকরি আমার মা-বাবাও করতেন। আমার ধারণা, তাঁরাও শোনেননি। তাই অফিসে কারও জন্মদিনের কেক কাটতে আমরা এইচআরকেই ডেকে আনি। কাটাকাটির কাজটা তারা খুব ভালো পারে।

লেগুনায় বসে এসব কথা ভাবছিলাম। জায়গামতো নেমে রিকশা খুঁজছি। অনেক দিন ধরেই খেয়াল করছি, ঢাকার রিকশাচালকেরা বেশ উদাস। গন্তব্যের কথা দুবার বলতে হয় তাঁদের। যদি বলি, ‘যাবেন কাকলী?’

: কই?

: কাকলী!

: না।

শুধু তা–ই নয়। তাঁরা বেশ চিন্তাশীলও বটে। আজও তার প্রমাণ পেলাম। ‘২০ নম্বর রোড যাবেন?’ বলতেই রিকশাচালক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘২০ নম্বর রোড?’

: হ্যাঁ।

: লেকের সামনে?

: হ্যাঁ। যাবেন?

: একেবারে মাথায় নামবেন?

: হ্যাঁ। যাবেন নাকি?

: না, মামা।

এই যে রিকশাচালকের সঙ্গে কথোপকথন, এগুলোর জন্যও তো সময় লাগে। গড়ে দুই মিনিট ধরলেও পাঁচটা রিকশার জন্য ১০ মিনিট। এটা কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত। তাদেরকেও তো চিন্তাশীল হতে হবে, নাকি! অবশ্য আমি সে আশাও করি না। আশা একটাই—আজও যেন দেরি না হয়।

তবু দেরি হলো। এবং অফিসে ঢুকেই মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো এইচআরের একজনের সঙ্গে। আমাকে দেখেই তিনি মুচকি হাসলেন। মনে হলো, দেরিতে আসায় মজা পেয়েছেন খুব! লেট করেছি, বেশ করেছি!

ডেস্কে বসতেই শুনি, বস ডেকেছেন। বসের ডাক প্রকৃতির ডাকের মতোই! সাড়া না দিয়ে কোনো উপায় নেই। আজ দিনটাই খারাপ। বসের রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখি, হেড অব এইচআর বেরিয়ে আসছেন। যা বোঝার বুঝে নিলাম। ভেতরে ঢুকতেই বস পর্যাপ্ত পরিমান ভাব আর গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, ‘আজও লেট?’

: রাস্তায় জ্যাম, স্যার।

: জ্যাম তো রাস্তায়ই হবে। ঘরের ভেতর জ্যাম দেখেছেন? যা–ই হোক, কাজের কথা। লোগোটার কী অবস্থা?

: মেইল করে দিয়েছি ক্লায়েন্টকে।

: মানে? কালই ডিসিশন হয়েছে, ওদের কাজ এখন ডেলিভারি করব না। আপনি মেইল করে দিলেন?

: স্যার...তা তো আমি জানতাম না। মানে, জানানো হয়নি আমাকে।

: যেটা জানেন না, সেটা করেন কেন? করার আগে একবার জেনে নেবেন না? এটাও তো আপনার দায়িত্ব, নাকি? এরপর থেকে না জেনে কিছু করবেন না।

: জি।

: আর শুনুন, এটা একটা অফিস। এখানে নিয়মকানুন আছে। আজও এইচআর অভিযোগ করল। বারবার বলার পরও আপনি ক্যাজুয়ালি আসেন। ইন করেন না। স্যান্ডেল পরে চলে এসেছেন! টোটালি আন–অ্যাকসেপ্টেবল। জানেন না, এ ফ্লোরে এমডি স্যার আছেন? এসব চলবে না। কাল থেকে ফরমালি আসবেন এবং অন টাইমে। এটা অফিস। বিনোদনকেন্দ্র নয়।

বস বারান্দায় গেলেন ধূমপান করতে। তাঁর পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। অনেকেই অফিসে এসে শ‌ু খুলে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে থপাথপ শব্দে হাঁটেন। কোনো সমস্যা হয় না। আর আমি স্যান্ডেল পরলেই দোষ! অথচ জয়েন করার সময় এই লোকটাই বলেছিলেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশন। ফিল ফ্রি। নিজের বাড়ি ভেবে রিল্যাক্সে কাজ করবেন।’

রিল্যাক্সের এই নমুনা? ইন করতে হবে, জুতা পরতে হবে—স্কুল নাকি এটা? এমনিতেই জ্যাম ঠেলে ঠিক সময়ে আসতে পারি না। এসব করে এলে তো লাঞ্চের সময় হয়ে যাবে। তা ছাড়া ইন করার কারণটা কী? আপনিই তো বললেন, ‘না জেনে কিছু করবেন না।’ ইন কেন করতে হয়? এতে কি কাজের দক্ষতা বাড়ে? আমি একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। আমার কাজ ডিজাইন করা। ইন করলাম কি না, জুতা পরলাম কি না, সে প্রশ্ন আসে কেন? নাহ্, এ অফিসে আর না। আমি স্বাধীনচেতা মানুষ। স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না। আজই চাকরি ছেড়ে দেব। নিচে গেলাম চা খেতে। চাকরি যখন করবই না, ডেস্কে বসে থেকে লাভ কি? চা খাই। উপভোগ করি সময়টা।

চা দোকানদার মন্টুকে বললাম, ‘সেই রকম করে একটা চা বানা তো। তোর বানানো চা খেয়েই চাকরি ছেড়ে দেব।

: এই নিয়া কয়বার ছাড়লেন?

: এবার ফাইনাল। চাকরি যে করে, সে চাকর। বস যা ইচ্ছা বলবে। আরে, আমার কাজ ডিজাইন করা। শ‌ু পরলাম কি না, তাতে কী আসে যায়? আমি কি ঠ্যাং দিয়ে ডিজাইন করব? চাকরি করি বলে যেন মাথা কিনে নিয়েছে!

: চা লন। জুতা নিয়া ধরছে?

: শুধু জুতা? ইন কেন করি না সেটাও সমস্যা। নিজেরা তো আসে গাড়িতে। বাস-লেগুনায় ঝুলে আসুক, তখন দেখব কত শার্টে কত ইন! ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০-১২ ঘণ্টা তো বাইরেই থাকি। একটা মানুষ এই গরমে এতক্ষণ শ‌ু পরে, ইন করে বসে থাকবে—এর মানে কী? রাস্তায় বৃষ্টির পানি, কাদা, ভিড়, ধাক্কাধাক্কি আর আমরা শ‌ু পরে ইংরেজ হয়ে যাব একেবারে! যত সব ফালতু নিয়ম।

: এতক্ষণ পরবেন ক্যান? বুদ্ধি খাটাইলেই তো অয়।

: কী?

: একটা বাক্সে জুতাডি নিয়া আইবেন। দোকানে রাইখা দিমু। ডেইলি আপনে স্যান্ডেল পইরা আইবেন। তারপর এইখানে বইসা জুতা পইরা নিবেন। তারপর সুন্দরমতো অফিস যাইবেন। টেবিলের তলে রাখবেন স্পঞ্জের চপ্পল। ব্যস, সারা দিন বসগো মতো ওডি পইরা ঘুরবেন। যাওনের সময় জুতা খুইলা আবার বাক্সে রাইখা যাইবেন। আমার দোকানে কোনো সমস্যা নাই।

আমি মন্টুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আরে, এই বুদ্ধি আমার মাথায় এল না কেন? আসলে চাকরি করলে মাথায় কিছু থাকে না। অফিসই সব শুষে নেয়। মন্টু তো চাকরি করে না। তাই হয়তো ওর এত বুদ্ধি! চায়ের বিল দিয়ে উঠলাম। মন্টু বলল, ‘চাকরি ছাড়তে যাইতাছেন?’

: কেন? জুতার বাক্স রাখতে পারবি না?

: হ, পারুম।

: তাইলে দেখি আর কিছুদিন।

তারপর থেকে ফরমাল হয়ে গেলাম। এইচআর অবাক হলেও কিছু বলে না।