রবিউল ভাইয়ের স্বপ্ন বেঁচে আছে

রবিউল করিমের গড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতিষ্ঠান ব্লমসের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে
সংগৃহীত

আঁধারের বুক চিরে পুব আকাশে বেরিয়ে আসে ভোরের সূর্য। আলোকিত হয় চারদিক। মানুষের নতুন দিনের শুরু হয় প্রত্যাশায়, স্বপ্ন নিয়ে।

আমার জীবনেও এমন একজন ‘রবি’ ছিলেন। তাঁর ছায়ায় আমার স্বপ্ন দেখা, বেড়ে ওঠা। তিনি আমার ভাই। রবি ভাই সবার কাছে রবিউল করিম নামে পরিচিত। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি উদ্ধার অভিযানে জঙ্গি হামলায় আমাদের ছেড়ে চলে যান। রবিউল ভাই সে সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

২০০৬ সালে বাবাকে হারানোর পর বাবার আদর–স্নেহে, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার চাদর দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছিলেন ভাই। তাই ভাইকে হারিয়ে আমিসহ আমার পুরো পরিবার যে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি বা যাচ্ছি, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ব্লুমস বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে

আমাদের বাড়ি মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার কাটিগ্রামে। ভাইয়ের বেড়ে ওঠা এই গ্রামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পড়াশোনা শেষে ৩০তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে পুলিশে যোগদান করেন। এর আগেই তিনি নিজ গ্রামে ২০১১ সালে অযত্নে আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ব্লমস (বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি)। উদ্দেশ্য, কিছুটা সময়ের জন্য হলেও তাদের সুন্দর পরিবেশে রাখা, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি গ্রাম বদলের চিন্তা থেকে নজরুল ইসলাম নামের আমাদের মামার সহযোগিতায় গ্রামের সাধারণ পরিবারের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নজরুল বিদ্যা সিঁড়ি স্কুল।

রবিউল করিম এখন শুধুই ছবির মানুষ

ভাইয়ের শাহাদতবরণের পর ব্লুমসের দায়িত্ব নেন ভাইয়ের বেশ কয়েকজন ভ্রাতৃপ্রতিম অগ্রজ, বন্ধুরা। এখন পর্যন্ত তাঁদের মানবিক চিন্তা–চেতনা ও সহযোগিতার মধ্য দিয়েই চলছে ব্লুমস। ব্লুমস পরিবারে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অর্ধশত শিক্ষার্থীর জীবনমান পরিবর্তনে তাঁদের ভাবনার শেষ নেই। এই মানবিক মানুষেরা দূরে অবস্থান করলেও তাঁদের চিন্তা ও ভাবনার পুরোটাজুড়েই থাকে ব্লুমসের শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার।

রবিউল করিমের প্রতিষ্ঠিত ব্লুমসের কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁর শুভাকাঙ্খিরা
ছবি: সংগৃহীত

নিজের পরিবারের মতোই তাঁরা সবাইকে এই করোনাকালীন দুর্যোগে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্ধশত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একাধিকবার খাদ্যসামগ্রী, করোনা মোকাবিলায় সহায়ক উপকরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঈদের আগে তাঁদের চিন্তা যেন বেড়ে যায় আরও বহুগুণে, নিজেরা সবাই মিলে আর্থিক সহায়তা তুলে সবার আগে এই অর্ধশত পরিবারের জন্য ঈদসামগ্রী নিশ্চিত করেন। শীতকালে প্রতিষ্ঠানে ছুটে আসেন শীতের পোশাক নিয়ে। রবি ভাইয়ের অসম্পন্ন স্বপ্নগুলোর পূর্ণতা এনে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই মানুষেরা।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সহায়ক উপকরণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক, জেলা প্রতিবন্ধী সাহায্য ও সেবাদান প্রতিষ্ঠান ও সিআরপি। শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণ ও খেলাধুলার জন্য ডোবা ভরাট করে ব্লুমসের আঙিনা বড় করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসনও।

একঝাঁক মানবিক মানুষের সহযোগিতায় রবি ভাইয়ের ব্লুমস এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্যের দিকে। আসুন, আমরা শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন শিশুদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতার হাতকে প্রসারিত করি। আমাদের ভালোবাসা, মায়া-মমতায় ভালো থাকুক, বেড়ে উঠুক শিশুরা।

লেখক: রবিউল করিমের ছোট ভাই।