রমনার পূজার দায়িত্বে প্রথমবার নারীরা

রমনা কালীমন্দিরে প্রথমবারের মতো দুর্গাপূজার আয়োজনে থাকছেন নারীরা
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

রাজধানীর রমনা কালীমন্দিরের দুর্গামণ্ডপের অন্তত দেড় শ গজ সামনে থাকা ফটকে চোখ আটকে যায়। ফটকের ঠিক ডান পাশে বিরাট এক ক্যানভাসে আঁকা ছবি। মানুষের ছায়া পড়লে যেমনটা লাগে, এটাও তেমনি। শুধু অবয়ব। দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটি দেবী দুর্গার। তাঁর কাঠামোতে যা থাকে, অর্থাৎ দুর্গা, তাঁর পায়ের নিচে সিংহ আর ত্রিশূলবিদ্ধ অসুর, এখানেও তা-ই রয়েছে। মন্দির কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি ছায়ামূর্তি।

এবার এ পূজার আয়োজনে বিশেষত্ব আছে। সেটি হলো, প্রথমবারের মতো দেশের অন্যতম এই বৃহৎ মন্দিরের দুর্গাপূজার ভার নারীরা নিয়েছেন। এই বিশেষত্বের এক প্রতীকী উপস্থাপন ছায়ামূর্তি।

রমনা কালীমন্দির দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন পরিষদের দায়িত্ব পাওয়া সাধারণ সম্পাদক তিলোত্তমা সিকদারের কথা, ‘দেবী দুর্গার নানা রূপ। কখনো তিনি কালী, কখনো মাতৃস্বরূপা। তিনি নারী শক্তির প্রতীক। প্রত্যেক নারীর মধ্যে এ শক্তির সঞ্চয় আছে। অন্তর্নিহিত এ শক্তি তুলে ধরতেই ছায়ার এ আদল।’

পঞ্চমীর সন্ধ্যায় ১০ অক্টোবর মন্দির প্রাঙ্গণে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। দেবীমূর্তি সাজানো হচ্ছে। নীলচে মরিচবাতির ঝালর পড়ছে মন্দিরের নানা প্রান্তে। ডেকোরেটরের কাজের ঠুক ঠুক শব্দ। এত কাজ সামলাতে গলদঘর্ম পূজা কমিটির আহ্বায়ক চৈতী রানী বিশ্বাস। তাঁর মুঠোফোনে বারবার ফোন আসছে। এটা-ওটা নির্দেশ দিচ্ছেন। চৈতী জানান, সারা দিন ছুটেছেন রাজধানীর নানা প্রান্তে, নিমন্ত্রণ জানাতে।

রমনার দূর্গামণ্ডপ
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

এবার নারীদের দায়িত্বে রেখে পূজা উদ্‌যাপন কেন? জবাবে চৈতী বলেন, ‘পূজা আয়োজন নারীদের চিরাচরিত দায়িত্ব ফুল তোলা, প্রসাদ তৈরি, নাড়ু বানানো—এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কেন তাঁরা দায়িত্ব নিতে পারবেন না? নারীশক্তির আরাধনার দায়িত্ব তাই এবার আমরা নিলাম।’

এবার এ মন্দিরে নারীর অংশগ্রহণ ঘটেছে নানা পর্বে। যেমন মহালয়ার ভোরে চণ্ডীপাঠের কাজ সাধারণত পুরুষেরাই করেন। এবার এ মন্দিরে এসে চণ্ডীপাঠ করেছেন চট্টগ্রামের শঙ্কর মঠের নমিতা চক্রবর্তী।

মন্দির কর্তৃপক্ষ জানান, পূজামণ্ডপে প্রতিমার কাছে এবার নারীরাই থাকবেন। শুধু মন্দিরে নয়, এবার নারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সামলাবে মন্দিরের শৃঙ্খলার কাজ। বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিমাদর্শন থেকে অন্যান্য সহায়তার জন্য নারীদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর করোনাকালে মন্দিরে কাউকেই মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দেওয়া হবে না। ফটকে থাকবে স্যানিটাইজার ও মাস্কের ব্যবস্থা। এসবের ব্যবস্থাপনায় থাকছেন নারীরাই।

মন্দিরে দেখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত-মৈত্রী হলের ছাত্রী সুস্মিতা দের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ মন্দিরের পূজা কমিটিতে নারীরা আগেও ছিলেন। কিন্তু প্রধান দুই পদে এই প্রথম নারী। জাতীয় পর্যায়ের এ মন্দিরে নারীদের অংশগ্রহণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।

রমনা কালীমন্দিরের বয়স প্রায় ৪০০ বছর। এখানে কবে থেকে দুর্গাপূজা হয়, এ নিয়ে সঠিক ইতিহাস জানা নেই কারোর। তবে এখানে কখনো মূল দায়িত্বে নারীরা ছিলেন, এমনটা হয়নি—জানান এ মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা। তাঁর কথা, ‘একটা পূজার দায়িত্ব পেলে যে নারীর ক্ষমতায়নে বড় কিছু ঘটবে, তা হয়তো নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা সেই ক্ষমতায়নের কথাটা বলতে চাই। এবারে নারীদের দায়িত্ব পাওয়া সেই ক্ষমতায়নের একটি প্রতীকী রূপ।’

মন্দিরের নানা আয়োজনে প্রতীকের উপস্থিতি। যেমন মন্দিরের সামনের পুকুরের ঠিক মাঝখানে রাখা হয়েছে লক্ষ্মী-নারায়ণের মূর্তি। পুকুরের জলে ছড়িয়ে আছে পদ্ম, শাপলা। তারই মাঝে এ দুই দেব-দেবীর অধিষ্ঠান। চৈতী বিশ্বাস বলেন, ‘নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রতীক এটি। এ সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে গেছে তাঁদের এই যূথবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমরা সে কথাই বলতে চেয়েছি।’