রাংরাপাড়ায় সূর্যবরণ

১ জানুয়ারি সূর্যব​রণের পর পুকুরে ভাসানো হয় রংবেরঙের বেলুন। ছবি: ওয়ালিদ উদ্দিন
১ জানুয়ারি সূর্যব​রণের পর পুকুরে ভাসানো হয় রংবেরঙের বেলুন। ছবি: ওয়ালিদ উদ্দিন

গুগল ম্যাপসে ঢাকা থেকে হালুয়াঘাটে যেতে লাগার কথা চার ঘণ্টা। বাসের সহযোগী বললেন, ‌‘পাঁচ ঘণ্টার বেশি লাগত না’। কিন্তু হালুয়াঘাট স্টেশনে শেষবারের মতো বাস যখন শেষ ব্রেক কষল, ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে পাক্কা ১০ ঘণ্টা। ৩১ ডিসেম্বর যাত্রার প্রাথমিক ধকল সামলে আমরা আবার অটোরিকশায় রাংরাপাড়ার পথ ধরলাম। উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটারের রাস্তা। আগে থেকেই জানা ছিল, গারো পাহাড়ের পাদদেশে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে হবে এবারের সূর্য উৎসব। কিন্তু রাংরাপাড়া নামে যে গ্রামে আমরা ক্ষণিকের অতিথি হলাম, সেখানে পাহাড়ের ছিটেফোঁটাও নেই। তবে লালমাটি, পাহাড়ি গুল্মলতা আর সরু খালের মতো ঝরনার অস্তিত্ব জানান দিল, আমরা পাহাড়ের পাদদেশেই আছি!

 জানিয়ে রাখি, সূর্য উৎসব জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মিত কার্যক্রম। বছরের প্রথম দিনটিতে দেশের অপরিচিত বা সাধারণত যাওয়া হয়ে ওঠে না—এমন জায়গায় অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পের আয়োজন করে থাকে সংগঠনটি। সূর্য উৎসবে নানা আয়োজনের একটি হলো বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখা।

১৭তম আয়োজনে এবার ঘাঁটি ছিল এই রাংরাপাড়া। খুব ছোট একটা দল নিয়ে হয়েছে এবারের সূর্য উৎসব। আমাদের ১২ জনের দলে যেমন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন, তেমনি সরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ীসহ আরিয়ান আলমের মতো সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীও। প্রথমবারের মতো সূর্য উৎসবে আসা তিন মানবের একজন আমি। তাই শুরু থেকেই উৎসাহ একটু বেশি ছিল।

রাংরাপাড়ায় আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি ব্যাপ্টিস্ট চার্চে। সেই চার্চের আধাপাকা একটি কমিউনিটি সেন্টার বরাদ্দ ছিল আমাদের জন্য। দুপুরের খাওয়া শেষ করেই উৎসবের এক দিনের পরিকল্পনা জানিয়ে দেন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মশহুরুল আমিন।

রুটিন ধরে পুরো বিকেলবেলা কাটল ভারত সীমানাঘেঁষা গ্রাম ঘুরে। রাংরাপাড়া গ্রামটিতে গারো সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস বেশি। দোকান এবং বাড়ি বাড়ি তাই হয়তো এখনো লেগে আছে বড়দিনের উৎসবের ছোঁয়া।

ওড়ানো হয় ফানুস
ওড়ানো হয় ফানুস

রাত বাড়ে উৎসবের আলোয়
সন্ধ্যায় শুরু হয়েছিল বর্ষবরণ প্রস্তুতি। আলোকসজ্জার জন্য রঙিন কাগজ কাটা। সূর্যোদয় দেখার জন্য সূর্যমুকুট বানানো, বেলুন ফোলানো—চলতে থাকে প্রস্তুতি।
রাত বাড়তেথাকে, বাড়তে থাকে স্থানীয় মানুষের আনাগোনাও। উৎসুক অনেকে এসে হাজির হন চার্চের পাশে। শুরু থেকেই আগন্তুকদের নিয়ে গ্রামের ছেলে-বুড়োদের আগ্রহের কমতি ছিল না। সেটা বাড়তে থাকে সন্ধ্যার পর। উৎসবে শামিল হলেন অনেকেই। পুরো চার্চ তখন মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। চার্চের পালক সাইমন সুহাস বারবার আমাদের খোঁজ নিচ্ছিলেন। তিনিই ডাকলেন কীর্তন দলের সুমন ঘাঘরাকে। বাদ্য-বাজনায় রাংরাপাড়া তখন উৎসবের নগরী। পাশেই ফানুস ওড়ানো হচ্ছিল। আগুন জ্বালানো নিয়ে বারবিকিউ আয়োজন থমকে ছিল। রবিনসন রাও নামে এক যুবক সবাইকে তাক লাগিয়ে সেটা সফল করলেন। এভাবেই সময় গড়িয়ে ১২টা ১। শুরু হলো নতুন বছর। কিন্তু আমাদের রাত্রিকালীন আয়োজন চলল আরও ঘণ্টা দুই।

স্বাগত সূর্যোদয়

পুরো গ্রাম তখনো আড়মোড়া ভেঙে জাগেনি। আমরা প্রস্তুতি নিলাম বছরের প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানানোর। মাথায় সূর্যমুকুট পরে বেরিয়ে পড়লাম। তবে বেশিদূর যেতে হলো না। চার্চ পার হয়ে কয়েক কদম এগোতেই খোলা মাঠ। তারপর যেখানে গ্রাম শুরু, সে গ্রামের ওপরে রক্তিম সূর্য। এ সূর্য ২০১৭ সালের প্রথম সূর্য।

উৎ​সবের প্রস্তুতি
উৎ​সবের প্রস্তুতি

আঁকতে নেই মানা
চার্চের পাশেই রাংরাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়েই আয়োজন করা হয়েছিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। খুদে শিক্ষার্থীরা গ্রাম, মাছ, পাখি, ফুল, ফল—যার যা ইচ্ছা, মনের মতো এঁকেছে। তাদের মধ্যে সেরা ২০ জনকে করা হয়েছে পুরস্কৃত।
যাত্রা শুরু থেকেই দলের অনেকের কাছে শুনেছি আগের সূর্য উৎসবগুলোর বর্ণিল আয়োজনের গল্প। তখন মনে হয়েছে, আহা, কী ভুলটাই না করেছি আগের উৎসবে না গিয়ে!
কিন্তু বিদায়বেলায় সেই তাঁরাই জানালেন, এ বছরের মতো এমন সুন্দর আয়োজন আর কোনোটাতেই হয়নি! পথের দুর্ভোগ ভুলিয়ে দিয়েছে রাংরাপড়ার মানুষগুলোর আতিথেয়তা।