রান্না দিয়ে মাত করেছেন মালিহা

ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করার পরপরই মালিহা মান্নানের বিয়ে হয়ে যায়। কিছুদিন পরই যৌতুক নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে মনোমালিন্যের শুরু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কে তিক্ততা বাড়তে থাকে। সন্তান পেটে আসার পর শ্বশুরবাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে খুলনার খালিশপুরে বাবার বাড়িতে চলে এলেন। গর্ভকালীন পুরো সময়টাই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ঝামেলা চলতে থাকে। মেয়ে মার্সিহা নাওয়ারার জন্মের এক মাসের মাথায় হাতে পান বিচ্ছেদের চূড়ান্ত নোটিশ।

আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করেই এগিয়েছেন মালিহা মান্নান
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

মালিহা বলছিলেন, ‘ডাকযোগে একটা চিঠি পাওয়ার পর খুলে দেখি ডিভোর্স লেটার। জানতামই না যে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। বাচ্চার খরচের কথাটা ভাবনায় এল। আমাকে আমার মা-বাবা দেখছেন। আমার বাচ্চাকেও তাঁরা দেখবেন—এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার মনে হয়েছে, আমার বাচ্চার দায়িত্ব আমারই নেওয়া উচিত। আর এ জন্য যত দ্রুত কিছু শুরু করব, ততই আমার জন্য মঙ্গল।’

খারাপ ওই সময়টাতে কিছু একটা করার জন্য বন্ধু-স্বজনেরা মানসিকভাবে উৎসাহও জোগাচ্ছিলেন। সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনার প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শই বেশি আসছিল। তবে পড়াশোনা করে চাকরি পাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তখন মালিহার ছিল না। আবার তাঁর পড়াশোনার বিষয় ‘ক্লদিং অ্যান্ড টেক্সটাইল’-এ খুলনায় কোনো চাকরি পাওয়াটাও সম্ভব ছিল না। মাথায় একবার চিন্তা এল ঢাকায় চলে যাবেন। কিন্তু ‘একা মা’ সন্তান নিয়ে ঢাকায় চাকরি করার সাহস পেলেন না। ঠিক করলেন, যা করার খুলনাতে থেকেই করবেন।

দেশে তখন অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার প্রসার হচ্ছে। মালিহার পরিচিত অনেকেই ছোটখাটো করে শুরু করেছেন। বুঝতে পারছিলেন খুলনাতেও এটা শুরু হবে। সন্তানের বয়স যখন চার মাস, চিন্তা করলেন, মাস দুয়েক পরে তো কিছু না কিছু করার জন্য বাইরে বের হতেই হবে। তার আগে অনলাইনে কিছু করা যায় কি না দেখি। এই ভাবনা থেকেই ঘরে তৈরি খাবার অনলাইনে বিক্রির চিন্তা। তবে খুলনায় তখনো অনলাইন খাবারের ব্যবসার তেমন চল ছিল না। মানুষ সেবা নেবে তো, কীভাবে পণ্য পৌঁছে দেবেন, এসব ভাবনাও ছিল। প্রাথমিকভাবে ফেসবুকে ‘মালিহাস টেস্টি ট্রিট’ নামে পেজ খোলেন।

সেই পেজ এখন খুলনায় বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। মালিহা মান্নান বলছিলেন,‘রান্নাবান্নায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান না থাকলেও ছোটবেলা থেকে রান্না করতে খুব ভালোবাসি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বন্ধুমহল আমার রান্নার অনেক প্রশংসাও করত। নতুন কিছু রান্না ভালো লাগত। মা-খালাদের সবার রান্না ভালো। রান্নার বিভিন্ন চ্যানেল দেখতাম, ভালো রন্ধনশিল্পীদের ফলো করতাম, পরে ইউটিউব দেখেও অনেক শিখেছি। সব মিলিয়ে আমি যে রান্না করতে পারি, সেই আত্মবিশ্বাসটা আগেই ছিল।’ সেই আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করেই শুরু হলো মালিহার নতুন পথচলা।

ব্যবসা শুরুর পরও পেরোতে হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। খুলনায় তখন ফুড ডেলিভারি করার একটামাত্র কোম্পানি। তাদের সঙ্গে কয়েক মাস কাজ করার পর ডেলিভারি চার্জের বাইরে অতিরিক্ত কমিশন দাবি করে তারা। এরপর নিজেই খাবার সরবরাহ করা শুরু করেন মালিহা। তবে খাবার প্রস্তুত করে সরবরাহ করাটা ভীষণ ঝামেলার হয়ে যাচ্ছিল। পরে স্থানীয় একজনের সঙ্গে চুক্তি করেও সময় ব্যবস্থাপনার জটিলতায় অনেক ফরমাশ বাতিল হতে থাকে। খুলনায় খাবার সরবরাহের নতুন নতুন কোম্পানি আসায় এখন জটিলতা অনেক কমেছে।

সন্তানের সঙ্গে মালিহা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

মালিহা বিভিন্ন ধরনের ফ্রোজেন আইটেম, নানা পদের পিৎজা, কাচ্চি বিরিয়ানি, স্পেগেটি, ইলিশ-পোলাও, পাস্তা, তেহারি, চিকেন ফ্রাই, শর্মা, দুধ খেজুর পিঠা, দুধ লাউ, মালাই জর্দাসহ বাঙালি, মোগল, চায়নিজ, মিষ্টি, ঝাল স্বাদের কম করে ২৫ ধরনের খাবার অর্ডার অনুযায়ী তৈরি করেন। গ্রাহকের চাহিদামতো বিশেষ খাবারও তৈরি করেন। তাঁর তৈরি বিরিয়ানি, স্পেগেটি, দুধ খেজুর পিঠা, মালাই জর্দা খুবই জনপ্রিয়।

মাত্র হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে শুরু করেছিলেন মালিহা। এখন তাঁর পুঁজি ১২ লাখের বেশি। প্রতিদিনই তাঁর পেজ থেকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আর মাসে কম করেও ৪ লাখ টাকার খাবার বিক্রি হয়। মালিহার এই ব্যবসার সঙ্গে এখন তাঁর বাবা, মা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছোট বোন—সবাই যুক্ত। এর বাইরে দুজন সাহায্যকারীও আছেন।

করোনার আগে বাবা শেখ এম এ মান্নান ঢাকার একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করতেন। মালিহা বলেন,‘ করোনার প্রথম দিকের বিধিনিষেধের ছুটিতে বাবা খুলনায় আসেন। ওই সময়ে গ্রাহকের খাবারের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সব সময় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল। বাবা আসায় সুবিধা হয়। ভরসা বাড়ে। এরপর বাবাকে আর ঢাকা যেতে দিইনি। ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছেন। সবাই একসঙ্গে থাকছি। সবাই মিলে মেয়ের দেখাশোনাও করাতে পারছি। বোনের পড়াশোনা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় খরচ চলছে এখন এই ব্যবসা থেকে।’

ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে মালিহা বলেন, ‘গুণমান আর সফলতা ধরে রেখে খাবার নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চাই। ফ্রোজেন ফুড নিয়ে একটা কারখানা দিতে চাই। বড় পরিসর নিয়ে একটা কিচেন করার ইচ্ছা আছে।’