রূপসজ্জায় রাঙায় রাইসা

মেয়ে সারাক্ষণ ল্যাপটপ কম্পিউটার নিয়ে কী করে? ইউটিউবে মেকআপ করার কৌশল শেখে? যাহ! মেয়ে তো গেছে। পড়াশোনা এবার লাটে উঠবে। গোল্লায় যাবে সব। ছেলেমেয়ে সারা দিন শুধু পড়ার বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলেই না জীবনে সফল হবে! বেশির ভাগ মা-বাবা এমনটাই মনে করেন। কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন রাইসা নওশিন। একেবারে ভিন্নধর্মী একটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে মা-বাবাকে গর্বিত করেছেন। পড়ছেন সবে মাত্র উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে, রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজে। এরই মধ্যে সৌন্দর্যচর্চা প্রতিষ্ঠান উইমেনস ওয়ার্ল্ড এবং এনটিভির আয়োজনে ‘চ্যালেঞ্জ উইথ কালারস’ নামের একটি রূপসজ্জা-বিষয়ক প্রতিযোগিতায় সারা দেশের ১ হাজার ৮০০ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন রাইসা।
২০ এপ্রিল প্রথম আলোর কার্যালয়ে বাবা এম রহমত আলীর সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন তিনি। রাইসার বাবা বলেন, ‘মেয়ে পড়াশোনায় কখনো ফাঁকি দেয়নি। তবে পড়া শেষ করেই বসে যেত কম্পিউটারের সামনে। ইন্টারনেটে নিত্যনতুন রূপসজ্জার কৌশল শিখত।’ এ নিয়ে শুরুতে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। কিন্তু এসএসসিতে ভালো ফলাফল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন মেয়ে। মা-বাবা বুঝতে পারেন, মেয়ে পড়াশোনাটা ঠিকমতোই চালিয়ে বাকি সব করছেন। বাবার এই মন্তব্যে সাড়া দেন রাইসা। ‘ক্লাসরুমে টিচারের লেকচার আমি সব সময় খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। আর পরীক্ষার আগের দিনগুলো বেশি করে পড়ি। সাজগোজের দিকে ঝোঁক থাকলেও তাই পড়ালেখার কোনো ক্ষতি হয়নি।’ বলেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই সাজগোজের প্রতি প্রবল ঝোঁক রাইসার। এখন মা তাহেরা আক্তার উৎসাহ দিলেও সেই সময় এ কারণে বকুনি দিতেন খুব। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাইসার পরিচয় হয়েছিল ইউটিউবের ‘মেকআপ টিউটোরিয়াল’-এর সঙ্গে। ছোট ছোট ভিডিও যেখানে সাজসজ্জার নানা কলাকৌশল শেখানো হয়। মেকআপকে যে এত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়, বিষয়টি তখনই মাথায় আসে তাঁর। এরপর নিজেই আটঘাট বেঁধে নেমে পড়েন। ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে মেকআপ করা শিখতে থাকেন। ইন্টারনেটে এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিও করেন। কিন্তু মেকআপসামগ্রী কেনার জন্য কখনোই বাড়ির লোকের কাছ থেকে টাকা নেননি। নিজের টিফিনের টাকা আর রিকশাভাড়া বাঁচিয়েই এসব কিনতেন।
সেরা মেকআপশিল্পী হিসেবে অল্প দিনেই এমন সাফল্য পাবেন তা কখনো আশা করেননি। আর বিশাল কিছু হওয়ার স্বপ্নও তাঁর ছিল না। তবে এখন দৃশ্যপট পাল্টেছে। এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এখন আরও বড় ‘মেকআপশিল্পী’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে যে এক লাখ টাকা পেয়েছেন, তা দিয়ে বাড়িতে একটি মেকআপ স্টুডিও দেবেন। কাজ করছেন উইমেনস ওয়ার্ল্ড বিউটি পারলারের সঙ্গে। পড়ার চাপ একটু কমলেই ইউটিউবের জন্য নিজের মেকাপ টিউটোরিয়াল তৈরি করার চিন্তাভাবনা করছেন।
‘খুব ভালো লাগে যখন কেউ আমাকে মেকআপশিল্পী হিসেবে সম্মান দেয়। আগেও বান্ধবী ও পরিচিত অনেকে আমার কাছে সাজতে আসত; কিন্তু এখন তারা আমাকে একটু অন্য চোখে দেখে। আরও বেশি মর্যাদা পাচ্ছি, এ বিষয়টা উপভোগ করি। শিক্ষকেরা আজ আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। আর আজকে এই কাজে যে এমন সফলতা পেয়েছি তার পুরো অবদান আমার বাবার।’
রাইসার পাশে বসে এতক্ষণ সব শুনছিলেন তাঁর বাবা এম রহমত আলী। এরপর বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘কেবল চিকিৎসক অথবা প্রকৌশলী হলেই জীবনে সফলতা আসবে, এমনটা আমি মনে করি না। ছেলেমেয়েদের যা করতে ভালো লাগে, তা-ই করতে দেওয়া উচিত। মেকআপে যেহেতু ওর এত আগ্রহ আর সে এই কাজে ভালোও করছে, আমার ইচ্ছা আছে এ বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ওকে বিদেশে পাঠাব।’ বোঝা গেল, মেয়ের ইচ্ছেই বাবার কাছে সব। বাবার সমর্থন সঙ্গে নিয়েই রাইসা যেতে চান বহুদূর।